Satyajit Ray: ‘তাঁর আঁকা ছবি আজও আমাদের পথ দেখায়’ সত্যজিৎ রায়কে স্মরণ একুশ শতকের শিল্পীদের

১৯৪১ সাল। শ্রাবণের বিষণ্ণতার ভার বাড়িয়ে বিদায় নিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর তার কয়েকদিন পর শান্তিনিকেতন ছাড়লেন এক তরুণ। একরকম মায়ের উপরোধেই পড়তে গিয়েছিলেন সেখানে। ফাইন আর্টসে ভর্তি হওয়া থেকে শান্তিনিকেতনে ‘মাস্টারমশাই’য়ের (নন্দলাল বসু) কাছে শিক্ষা সমৃদ্ধ করেছে তাঁকে। অন্যদিকে ‘বিনোদদা’ও (বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়) ছিলেন তাঁর বড় অনুপ্রেরণা। কিন্তু কর্মাশিয়াল আর্টের দিকে ঝোঁক থাকায় কোর্স শেষ না করেই শান্তিনিকেতন ছাড়লেন । ‘মাস্টারমশাই’কে সে কথা জানালেন, সম্মতি নিয়ে চলে এলেন কলকাতা।

তারপর ব্রিটিশ সংস্থা ডি জি কিমারে চাকরি। ইলাস্ট্রেশনের কর্মজগতে পা রাখলেন সত্যজিৎ। ডি জি কিমার যখন ছাড়ছেন, ততদিনে এঁকে ফেলেছেন বিখ্যাত সব বইয়ের কভার। নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বইতেই তাঁর হাতের কাজ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালি’ থেকে জিম করবেটের ‘ম্যানইটার অফ কুমায়ুন’। জওহরলাল নেহেরুর ‘ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া’ থেকে জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’। সংস্থার চাকরি ছাড়ার সময় আর্ট ডাইরেক্টর পদেও ছিলেন তিনি। তবে আঁকার নেশা পিছু ছাড়েনি। সিনেমা জগতে পা রাখার পরেও নানা সূত্রে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত আঁকা ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে। আঁকাকে অনেক ‘কাজ’এও লাগিয়েছেন। এক প্রবন্ধে সত্যজিৎ লিখেছেন, পথের পাঁচালির বৃষ্টির দৃশ্যের কথা। টাক আছে এমন লোকের মাথায় প্রথম ফোঁটা পড়বে, এভাবেই ভেবেছেন সে দৃশ্য। বোড়ালে শুটিংয়ের সময় কয়েকদিন আগেই লোকটিকে দেখেছেন তিনি। কিন্তু গ্রামবাসী কিছুতেই বুঝতে পারছেন না কে তিনি। শেষে স্মৃতি থেকেই তাঁর পোর্ট্রেট এঁকে দেন সত্যজিৎ। পোর্ট্রেট দেখতেই তৎক্ষণাৎ তাঁকে ধরে আনেন গ্রামবাসী। প্রতিভা এমনই!

বিখ্যাত সব বইয়ের কভার

(ছবি সৌজন্য: ফেসবুক)

১৯৬১ সালে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে শুরু ছোটদের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা। এরই ফলে শুরু হয় ঘন ঘন ছবি আঁকা। নিজের গল্পের পাশাপাশি অন্য লেখকের গল্পের হেডপিস থেকে ইলাস্ট্রেশনে তীক্ষ্ণ নজর ছিল সত্যজিতের। গল্পের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত প্রতিভার সাক্ষর ও যত্ন রেখে যেতেন তিনি। বইয়ের জগতে শুধু নয়, এর বাইরেও ছবির পোস্টার, বিজ্ঞাপন ও এমনকী সিনেমার চিত্রনাট্যের পাতায় পাতায় রেখেছেন ইলাস্ট্রেশন। ফটোগ্রাফ, আঁকা, সিনেমা, এই যে ‘দেখা’র নানা বিশেষ মাধ্যম, সত্যজিতের শিল্পীজীবনের যেন তা-ই উপজীব্য। বারবার এই ফর্মগুলোই ফিরে ফিরে এসেছে তাঁর কাজে।

<p>ছোটদের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা</p>

ছোটদের ‘সন্দেশ’ পত্রিকা

(ছবি সৌজন্য: ফেসবুক)

সত্যজিতের ইলাস্ট্রেশন একুশ শতাব্দীর বাঙালি শিল্পীদের কীভাবে প্রভাবিত করছে? তাঁর দীর্ঘ ‘আঁকিয়ে’ জীবনের দিকে তাকাতে এই প্রশ্নই প্রতিফলিত হওয়া স্বাভাবিক। জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন এই সময়েরই দুই বিখ্যাত ইলাস্ট্রেটর। কীভাবে তাঁদের আঁকায় বারবার ফিরে আসেন সত্যজিৎ? জানালেন অর্ক পৈতণ্ডী। ছোটদের পত্রিকায় ইলাস্ট্রেশনের জন্য নিয়মিত ডাক পড়ে তাঁর। ‘এখন যাঁরা ইলাস্ট্রেশন করেন, তাঁরা যে সবাই আর্ট কলেজের ছাত্র, তা তো নয়। বেশিরভাগ আর্টিস্টরাই গল্পের বইয়ের ইলাস্ট্রেশন দেখেই শিখেছেন কীভাবে কাজ করতে হয়। আমি নিজেও সেই দলেই পড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে সত্যজিৎ রায়ের ইলাস্ট্রেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে।’ ইলাস্ট্রেশন শেখার পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের আঁকার কোন কোন দিক তাঁকে বেশি টেনেছে সেটাও জানালেন অর্ক। বললেন,‘তাঁর আঁকাকে ক্যালিগ্রাফি, হেডপিস, ইলাস্ট্রেশন–এই তিনভাগে ভাগ করলে দেখা যাবে সবটাতেই তাঁর মুনশিয়ানা। যেমন ‘বৃহচ্চঞ্চু’ গল্পটা যখন বেরোল সন্দেশে, তখন প্রথম অক্ষর ব-টা হল বড় একটা ঠোঁটের মতো। আবার ‘বাদুড় বিভীষিকা’র হেডপিস দেখুন। পুরো লেখাটাই হয়ে যাচ্ছে বাদুড়ের মতো দেখতে। ‘খগম’এর ক্যালিগ্রাফিতে যেমন দেখা যাবে, একটা সাপ পেঁচিয়ে রয়েছে অক্ষরগুলিকে। ইলাস্ট্রেশনে আঁকার পাশাপাশি কতটা ফাঁকা স্পেস থাকবে। তাও কিন্তু তাঁর কাছ থেকেই শেখা। ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার’এও দেখা যাবে, একটা বিশাল বড় ব্যানার নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন, তাতে পটলবাবুর ছবি দিয়ে লেখা গল্পের নামটা। যেন ওটাই একটা পোস্টার!’

<p>প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়ের হেডপিস</p>

প্রোফেসর শঙ্কু ও হাড়ের হেডপিস

(ছবি সৌজন্য: ফেসবুক)

সত্যজিৎ রায়ের বেশ কয়েকটি কাহিনিকে কমিকসের রূপ দিয়েছেন অর্ক। মায়েস্ত্রোর গল্প থেকে কমিকস করার সময় কী কী কথা মাথায় রাখতেন? ‘আমার উপর ওঁর অসীম প্রভাব। যখন ওঁর গল্প নিয়ে কমিকস করেছি, চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব ওঁর আঁকার ধাঁচকে অনুসরণ করতে। যেমন‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ কমিকস করার সময় উনি বঙ্কুবাবু ও অ্যাংকে যেমন এঁকেছেন, আমিও তেমনভাবেই এঁকেছি। আবার মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে যেভাবে রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন সত্যজিৎ রায়, সেভাবেই এঁকেছি আমি।’

<p>বঙ্কুবাবু ও অ্যাং</p>

বঙ্কুবাবু ও অ্যাং

(ছবি সৌজন্য: অর্ক পৈতণ্ডী)

<p>বঙ্কুবাবুর বন্ধু</p>

বঙ্কুবাবুর বন্ধু

(ছবি সৌজন্য: অর্ক পৈতণ্ডী)

একুশ শতাব্দীর আর্টিস্টদের কাজ শেখার দিক থেকে কেমন প্রভাব সত্যজিৎ রায়ের? সেই কথাই বলছিলেন কার্টুনিস্ট শুভেন্দু সরকার। ‘কর্মজগতে আমরা যাঁদের শিক্ষক হিসেবে ভীষণ মেনে চলি, তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ রায় অন্যতম। তাঁর ছবির ওরকম এক্সপ্রেশন, ওরকম লাইন ড্রয়িং! এখনও আমার জুনিয়রদের তাঁর বিভিন্ন ছবির রেফারেন্স দিই। কাজ শেখার জন্য ওগুলোই তো পাথেয়!’ কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে ‘এক্ষণ’ পত্রিকার কথা। ‘এক্ষণ পত্রিকার ক্যালিগ্রাফির জন্য ২৫-২৬ রকমের ডিজাইন করেছিলেন সত্যজিৎ। পরে সেখান থেকে একটি বেছে দেন তিনি নিজেই।’ ছবি আঁকার সময় সত্যজিৎ রায়ের নিষ্ঠাও পরবর্তী প্রজন্মকে প্রচন্ডভাবে প্রভাবিত করেছে। শুভেন্দুর কথায়,‘সত্যজিৎ রায়ের কাজ যেমন দেখেছি, তেমন তাঁর কাজ করার স্টাইলের কথাও শুনেছি। প্রবীর সেন সেই সময় এক্ষণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দীর্ঘদিন সেই সব গল্প শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।’

<p>এক্ষণ পত্রিকার লেটারিংয়ের জন্য ২৫-২৬ রকমের ডিজাইন করেছিলেন সত্যজিৎ</p>

এক্ষণ পত্রিকার লেটারিংয়ের জন্য ২৫-২৬ রকমের ডিজাইন করেছিলেন সত্যজিৎ

(ছবি সৌজন্য: ফেসবুক)

সময় বদলাচ্ছে। ছবি আঁকার মাধ্যম পাল্টে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু ছবির ভাষার মৌলিক ব্যাকরণটুকু যাঁরা গড়ে দিয়ে গিয়েছেন তাঁদের মধ্যে সত্যজিৎ একজন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। শুভেন্দু কথায় কথায় বলছিলেন,‘চিত্র পরিচালক হিসেবে তিনি যে উচ্চতায়, ইলাস্ট্রেটর হিসেবেও সেই উচ্চতায় বিরাজ করছেন তিনি। এ কথাটা শুধু আমি নই, অন্য শিল্পীরাও তাই মনে করেন। তাঁকে মাথার উপর নিয়েই আমাদের কাজ করা।’ ‘তাঁকে মাথার উপর নিয়েই আমাদের কাজ’এর কথা উঠে এসেছে অর্ক পৈতণ্ডীর স্বীকারোক্তিতেও। এভাবেই হয়তো উঠে আসে সমসাময়িক অন্য শিল্পীদের কথায়, উঠে আসবে আগামী দিনের শিল্পীদের কথায়, কাজে। সত্যজিৎ ছবির অন্যন্যতা যাঁদের বারবার নানাভাবে প্রভাবিত করবে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাবে ফাইন আর্টের কোর্স মাঝপথে ছেড়ে শান্তিনিকেতন থেকে চলে আসা তরুণটির সৃষ্টি। আজ সেই তারুণ্যের উদযাপন!

—————————————————–

এই খবরটি আপনি পড়তে পারেন HT App থেকেও। এবার HT App বাংলায়। HT App ডাউনলোড করার লিঙ্ক https://htipad.onelink.me/277p/p7me4aup