ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে ইউক্রেনের কৌশল কী হবে?

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কৃষ্ণ সাগরীয় উপদ্বীপ বিষয়ক প্রতিনিধি তামিলা তাশেভা বলেছেন, ক্রিমিয়াকে মুক্ত করা হবে। পিছু হটার কোনও সুযোগ নেই আমাদের। তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন ২৫ এপ্রিল। তার এই মন্তব্য রাশিয়ার দখলকৃত ক্রিমিয়া মুক্ত করতে ইউক্রেনীয় পরিকল্পনায় গুরুত্বারোপ করছে।

জেলেনস্কি অঙ্গীকার করেছেন ৯ বছর আগে রাশিয়ার দখল করা ক্রিমিয়াকে মুক্ত করবে ইউক্রেন। জেলেনস্কি ও তাকে ঘিরে থাকা ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের এমন অঙ্গীকার ও মন্তব্যে দেশটিতে ক্রিমিয়া ফিরে পাওয়ার আশা দিন দিন বাড়ছে।

রাশিয়ার ১৪ মাসের বেশি সময় ধরে চলমান আক্রমণের এই পর্যায়ে ইউক্রেনের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ নিয়ে আলোচনা জোরদার হচ্ছে। কবে শুরু হবে পাল্টা আক্রমণ, এমন আলোচনা যখন চলছে কীভাবে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে পারে ইউক্রেন তা নিয়েও চলছে বিভিন্ন মহলে পর্যালোচনা।

তাশেভা একটি প্যানেলকে বলেছেন, জেলেনস্কি ইতোমধ্যে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন ক্রিমিয়া দখলমুক্ত করার পর কর্তৃপক্ষ কীভাবে কাজ করবে।

বসে নেই রাশিয়াও। রুশ সেনাবাহিনী আশঙ্কা করছে ক্রিমিয়া শিগগিরই রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে। মার্কিন মেরিন কর্পসের অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ও সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ডপ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিএসআইএস)-এর সিনিয়র উপদেষ্টা মার্ক কানসিয়ান তুলে ধরছেন উপদ্বীপ ঘিরে রাশিয়া নিজেদের প্রতিরক্ষা জোরদার করছে।

সিরিজ আক্রমণ

কানসিয়ান বলছেন, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু যত দ্রুত আশা করা হচ্ছে তত দ্রুত হয়ত মুক্ত করা যাবে না। তার মতে, দখলকৃত ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে ইউক্রেন দীর্ঘ সময় নিয়ে সিরিজ আক্রমণ চালাতে পারে। ডনেস্ক, লুহানস্ক, খেরসন, জাপোরিজ্জিয়া ও ক্রিমিয়াতে এসব সিরিজ হামলা চালানো হতে পারে।

অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন কর্নেল কানসিয়ান বলেন, রুশদের বিতাড়িত করতে শুধু একটি হামলাতে পাল্টা আক্রমণ সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা আক্রমণ শুরু করবে, এটি মাস ধরে চলতে থাকবে। এরপর এটির ফলাফল আসতে শুরু করবে। তখন আসবে পুনর্গঠনের পর্যায় এবং পরের আক্রমণ শুরুর করার সময়। সম্ভবত গ্রীষ্মের শেষ দিকে এমন অবস্থা দেখা দিতে পারে। ইউক্রেনের কৌশল হতে পারে এমন- আক্রমণ, কিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার, থামা, পুনর্গঠন এবং আবার আক্রমণ। স্পেনের গৃহযুদ্ধে এমকন কৌশল আড়াই বছর ধরে বাস্তবায়ন হয়েছে। ওই সময় জয়ীরা সিরিজ আক্রমণ চালিয়েছে, প্রতিটি আক্রমণে তারা নতুন কিছু ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করে।

কানসিয়ানের এমন মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর ইউরোপীয় কমান্ডের সাবেক উপ-কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল স্টিফেন টুইটি। বর্তমানে সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইলিসস এর ফেলো হিসেবে কর্মরত এই সাবেক সেনা কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে বিরোধপূর্ণ সীমান্ত প্রায় ৮০০ মাইল বিস্তৃত।

তিনি বলেন, আমার মনে হয় না ইউক্রেন বিস্তৃত ৮০০ মাইল সীমান্তজুড়ে আক্রমণের চেষ্টা করবে। এই সীমান্ত ডনবাস, খেরসন হয়ে ক্রিমিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। আমরা মনে হয় ইউক্রেন গত গ্রীষ্মের মতোই ছোট ছোট ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে চেষ্টা চালাবে, এক্ষেত্রে তারা বড় আকারের একটি আক্রমণ অভিযানের বদলে সিরিজ আক্রমণ চালাতে পারে।

ইউক্রেনের সম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণে ড্রোনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। ছবি: রয়টার্স

ড্রোন

সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো ও উপদেষ্টা স্যামুয়েল বেনডেট বলছেন, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারে ইউক্রেনে যেকোনও সম্ভাব্য আক্রমণের সম্মুখভাগে থাকবে ড্রোন।

তিনি বলেন, হামলার প্রথম ঢেউয়ে থাকবে ড্রোন, রুশরা এটা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন। এই ড্রোন হামলা হবে বড় আকারের। নিজেদের রক্ষা ও রক্ষার চেষ্টা করা ছাড়া রুশদের সামনে কোনও পথ খোলা থাকবে না। কয়েক মাস ধরে ক্রিমিয়ায় ড্রোন পাঠিয়ে রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরীক্ষা নিচ্ছে ইউক্রেন। ইউক্রেনীয় এজেন্ডায় ক্রিমিয়ার অবস্থান অনেক উচ্চ।

২০২২ সালের ১১ এপ্রিল থেকে ক্রিমিয়ায় হলুদ সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জারি রয়েছে। উপদ্বীপটিতে বিস্ফোরণের খবর এখন অনেক নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে। ২৪ এপ্রিল ক্রিমিয়ায় একাধিক বিস্ফোরণ হয়েছে। রাশিয়ার কৃষ্ণ সাগরীয় বহর দুটি ড্রোন হামলা প্রতিহত করার দাবি করেছে।

২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়ায় মস্কো মনোনীত প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সের্গেই আকসিয়োনভ মাস খানেক আগে বলেছিলেন, উপদ্বীপের জন্য বড় হুমকি হলো ইউক্রেনীয় ড্রোন।

বেনেডেট ব্যাখ্যা করে বলছেন, ইউক্রেন বিপুল সংখ্যক ড্রোন ব্যবহার করে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে চাপে ফেলে দিতে পারে, রাশিয়া এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এমন কিছু হলে রাশিয়াকে এসব ড্রোন ব্যবহারে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ গোলাবারুদ ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া এসব ড্রোন হামলা রুশ সেনাদের অবস্থানও জানিয়ে দেবে। তখন সেই অবস্থানে ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হানতে পারবে।

ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক উপদেষ্টা আন্তন গেরাশেঙ্কো ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন, চলমান সংঘাত হলো একটি ড্রোন যুদ্ধ। এগুলো দারুণ অস্ত্র। ট্যাংকের চেয়ে দাম কম, এবং দূর থেকে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত না হয়ে রুশ সেনাদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারছে ইউক্রেন।

গত কয়েক মাসে ইউক্রেনীয় সেনারা পশ্চিমাদের কাছ থেকে আধুনিক ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ছবি: রয়টার্স

বর্ধিত অবরোধ

কানসিয়ান বলছেন, ক্রিমিয়া পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় বর্ধিত অবরোধ জারির পথে হাঁটতে পারে ইউক্রেন। তিনি বলেন, ক্রিমিয়া মুক্ত করতে আক্রমণ নয়, অবরোধ হতে পারে ইউক্রেনের কৌশল। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী চেষ্টা করবে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সেতু কার্চ ধ্বংস করে ক্রিমিয়াকে রাশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করতে। এই সেতুটি রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার একমাত্র সংযোগ।

তিনি আরও বলেন, এটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আগের চেয়ে এটি এখন আরও বেশি সম্ভব। কারণ ইউক্রেন গত কয়েক মাসে অনেক বেশি অস্ত্র, অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ পেয়েছে। ফলে তারা যদি ক্রিমিয়া মুক্ত করতে চায় তাহলে এটিকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করতে এগুলোতে কাজে লাগাতে পারে।

কার্চ প্রণালীতে রাশিয়া-ক্রিমিয়া সংযোগ সেতু। ছবি: রয়টার্স

পুনঃসরবরাহ ঠেকানো

সাবেক উপ-কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল স্টিফেন টুইটি বলছেন, এক পর্যায়ে ইউক্রেনকে ক্রিমিয়াতে রাশিয়া থেকে পুনঃসরবরাহ ঠেকানো লাগতে পারে। হোক তা সরঞ্জাম বা সেনা। ইউক্রেনের পরিকল্পনায় ক্রিমিয়া হয়ত শুরুতে থাকবে, অথবা তারা হয়ত চেষ্টা বা হামলা করবে অন্যত্র, যেখানে রুশ সেনারা দুর্বল। হয়ত এসব হামলা ইউক্রেনকে ক্রিমিয়ায় আক্রমণের জন্য ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।  

কানসিয়ানও একই কথা বলছেন। তার মতে, উপদ্বীপ মুক্ত করতে রাশিয়ার পুনঃসরবরাহ ঠেকানো হবে গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি বলেন, ইউক্রেনীয় সেনারা আশা করতে পারে তারা ভূমিতে পৌঁছার আগেই উপদ্বীপের জলসীমায় অবরোধ জারি করবে, সেতু উড়িয়ে দেবে, ক্রিমিয়ায় পুনঃসরবরাহ পাঠানো চেষ্টা করা নৌযান দূর থেকে ধ্বংস করা, পদাতিক হামলার কয়েক সপ্তাহ বা মাস আগে সামরিক স্থাপনায় হামলা চেষ্টা।

রুশ সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পাওয়া নতুন সেনারা যোগ দিচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে। ছবি: রয়টার্স

ক্রিমিয়ায় সেনা মোতায়েন

টুইটি বলছেন, ক্রিমিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে হলে ইউক্রেনকে উপদ্বীপজুড়ে সেনা মোতায়েন করতে হবে। তিনি বলেন, সেনা মোতায়েন করতে না পারলে নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা যাবে না। যদি ভূখণ্ড রক্ষা করা না যায় তাহলে সেটি মুক্ত রাখা যাবে না।

তাই তিনি মনে করেন, আসন্ন পাল্টা আক্রমণের প্রথম ধাপে ক্রিমিয়া দখলের চেষ্টা করবে না ইউক্রেন। তাদের দূরবর্তী লক্ষ্যবস্তুতে আঘাতের অস্ত্রের ঘাটতি রয়েছে এবং ক্রিমিয়াকে সুরক্ষিত রাখার নৌশক্তি নেই। 

তিনি বলেন, তাই আমার মত হলো ক্রিমিয়ায় আক্রমণে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে পারার মতো অবস্থার আগে আক্রমণ না করা। কারণ এমনটি ছাড়া রাশিয়ার সেনাকে ধ্বংস এবং উপদ্বীপটি অবরোধ করা সম্ভব হবে না।

ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পডোলিয়াক আশাবাদী পাঁচ থেকে সাত মাসের মধ্যে ইউক্রেনীয় সেনারা ক্রিমিয়ায় অবস্থান করবে। তিনি বলেছেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে হয়ত খুব কম সময় হয়ে যায়। কিন্তু আমি আশাবাদী পাঁচ বা ছয় কিংবা সাত মাসের মধ্যে আমরা ক্রিমিয়া পৌঁছাবো। হয়ত এটি অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু গাণিতিকভাবে এই আশাবাদ যাচাই করা। আমি আবারও বলছি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা নেই রাশিয়া। যুদ্ধের যুক্তি একেবারে স্পষ্ট। আমরা নিশ্চিতভাবে ক্রিমিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করতে সক্ষম হব।

সূত্র: নিউজউইক