সাবেক স্বামীর পরিকল্পনাতেই কর কর্মকর্তা অপহরণ, গ্রেফতার ৩

সাবেক স্বামী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদের পরিকল্পনাতেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) যুগ্ম কমিশনার মাসুমা খাতুনকে অপহরণ করা হয়েছিল বলে জানিয়েছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। শনিবার (২৬ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি জানান, এ ঘটনায় তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হলেন, মাসুম ওরফে মাসুদ (৪২), আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) এবং হাফিজ ওরফে শাহিন (৪৮)।

র‍্যাব কর্মকর্তা কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, গত ১৭ আগস্ট রাত আনুমানিক সোয়া ৮টার দিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নারী যুগ্ম কর কমিশনার মাসুমা খাতুন রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে অপহৃত হন। অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করেন। 

এ ঘটনায় অপহৃতার সাবেক গাড়ি চালক  মাসুম ওরফে মাসুদ ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা (নং-২০/১৭৩, তারিখ-১৯ আগস্ট ২০২৩) দায়ের করেন তিনি।

ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয় উল্লেখ করে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, মামলা হওয়ার পরপরই র‍্যাব অপহরণের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে, র‍্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা, র‍্যাব-১ ও র‍্যাব-৩ এর যৌথ আভিযানিক দল গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় অভিযান চালানো হয়। সেখান থেকে মামলার প্রধান আসামি মো. মাসুম ওরফে মাসুদ (৪২), তার সহযোগী মো. আব্দুল জলিল ওরফে পনু (৪৮) ও মো. হাফিজ ওরফে শাহিনকে (৪৮) গ্রেফতার করা হয়। 

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে তথ্য র‍্যাবকে তথ্য দিয়েছে বলেও জানান খন্দকার আল মঈন।

তিনি আরও বলেন, ‘র‍্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, গ্রেফতারকৃত মাসুদ আগে কর কমিশনার মাসুমা খাতুনের গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিল। গত ১ আগস্ট তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন কর কর্মকর্তা। ফলে গ্রেফতারকৃত মাসুদের মধ্যে মাসুমা খাতুনের প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রোশের সৃষ্টি হয়।’

মাসুদ জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাবকে জানিয়েছে, তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় সে ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই নারীকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিল। হারুন অর রশিদও তার সাবেক স্ত্রীকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যেতে মাসুদকে আর্থিক ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন অর রশিদ তাকে অগ্রিম ৭০ হাজার টাকাও দেয়। কাজের পরে তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না ও উন্নত জীবনযাপন করার সকল ব্যবস্থা করে দেবে বলেও আশ্বাস দেয়। 

গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে মাসুদ সহযোগী হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে তার পরিকল্পনার কথা জানায় এবং সবাইকে টাকা বণ্টন করে দেয়। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়ি চালকের সঙ্গে গ্রেফতারকৃত হাফিজের সুসম্পর্ক রয়েছে। সেই সূত্র ধরে হাফিজই ভুক্তভোগী মাসুমা আক্তারের অবস্থান বর্তমান গাড়িচালকের কাছ থেকে জেনে গ্রেফতারকৃত মাসুদকে জানায়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১৭ আগস্ট রাত ৮টায় তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেয়। ভুক্তভোগী রাত সোয়া ৮টার দিকে রাজধানীর মগবাজার থেকে নিজের গাড়িতে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে অপহরণকারীরা একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির গতিরোধ করে। এসময় ভুক্তভোগীর ড্রাইভার মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করে এবং গ্রেফতারকৃত মাসুদ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এসময় গ্রেফতারকৃত পনুসহ অন্যান্য সহযোগীরা গাড়িতে উঠে বসে ভুক্তভোগীকে জোড় করে অপহরণ করে হাতিরঝিলের উদ্দেশে রওয়ানা দেয় এবং অপহরণের বিষয়টি ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদকে জানায়।

হারুন অর রশিদ অপহরণকারী হাতিরঝিলে একটি বাসার ঠিকানা দেয় এবং ভুক্তভোগীকে সেখানে নিয়ে যেতে বলে। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ওেই বাসার মেইন গেইট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। পরবর্তী সময়ে আনুমানিক রাত ১২টার দিকে কাঁচপুর এলাকায় গ্রেফতারকৃত মাসুদের পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী মাসুমা খাতুন।

পরদিন ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় নিয়ে জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করে অপহরণকারীরা। এ সময় গ্রেফতারকৃত মাসুদ ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে তাদের জুমার নামাজের পর সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। পরবর্তী সময়ে দুপুরে খাবার সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যায় এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ির সামনে পাহারায় থাকে। এসময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে এবং গ্রেফতারকৃত মাসুদ, পনু ও শান্ত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। 

পরবর্তী সময়ে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।

র‍্যাব কর্মকর্তা খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেফতার হওয়া মাসুদ পেশায় একজন গাড়িচালক। সে এর আগে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালাতো। বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক জনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্সটি বাতিল হয়। এছাড়াও সে গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গেও জড়িত ছিল বলে র‍্যাব জানতে পারে। ওই নারীকে অপহরণের পর সে রাজধানীর বাবুবাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুর শ্রীপুর এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিল। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকা থেকে র‍্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়।
আর গ্রেফতার হওয়া পনু পেশায় একজন সিএনজি চালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে গ্রেফতারকৃত মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। এ অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মাসুদ তাকে সাড়ে ৬ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করে। 

গ্রেফতারকৃত হাফিজও দূরপাল্লার বাস চালাতো। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে গ্রেফতারকৃত মাসুদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। এই অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মাসুদ তাকে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম প্রদান করে।