ফুলের ওপর রাসায়নিক রঙ, লুকিয়ে আছে যে ক্ষতি

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতো প্রিয়তমার জন্য ‘বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে’ আনতে হচ্ছে না ১০৮টি ‘নীলপদ্ম’! শুধু নীল কেন, যে রঙের চান সেই রঙেরই পদ্ম পাবেন হাতের কাছে! ফুলের মালায়, তোড়ায়, মাথার খোঁপায় বা বিয়ের গাড়ি, বাসরঘর, অনুষ্ঠানের মঞ্চ সাজাতে হরেক রকম ও বাহারি রঙের ফুল চান ক্রেতারা। তাদের চাহিদা মেটাতে সারা দেশ থেকে আসা তাজা ফুলের ওপর, অথবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে হালকা শুকিয়ে ক্ষতিকর রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করছেন বিক্রেতারা। রাজধানীতে খুচরা ও পাইকারি ফুলের প্রধান বাজার শাহবাগে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্ম ফুল বা লোটাসের ওপর দেদার ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক রঙ, যে রঙ মূলত ধাতব বস্তু বা কাঠের ওপর ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে।

প্রসঙ্গত, যশোরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষাবাদ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন জলাশয় থেকেও পদ্ম বা শাপলার মতো ফুল সংগ্রহ করে এনে বিক্রি করা হয়। যশোর-চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহে ফুলের পাইকারি বাজার ঘুরে বেশিরভাগ ফুলই মূলত আসে রাজধানী ঢাকায়। আমদানি করে বিদেশ থেকেও ফুল আনা হয় রাজধানীতে। তবে রাজধানীতে ফুলের অন্যতম বাজার শাহবাগে আসার পরপরই রাসায়নিক রঙ ব্যবহারের কারণে পাল্টে যাচ্ছে পদ্ম ফুলের প্রকৃত রঙ।

প্রাকৃতিক ফুলে এসব রঙের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কিনা বা কতটা ক্ষতিকর, তা না জেনেই এসব রঙ ব্যবহার করছেন বিক্রেতারা। ক্ষতি বা ঝুঁকির কথা না জেনে বা পাত্তা না দিয়ে এসব ফুল অবাধে কিনছেন ক্রেতারাও।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহবাগের প্রায় প্রতিটি দোকানে বিক্রি হচ্ছে রাসায়নিক রঙ দেওয়া ফুল। মূলত পদ্ম বা লোটাস ফুলেই রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে বেশি। এখানকার ফুল ব্যবসায়ী আলামিন জানান, বছরজুড়েই গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধার পাশাপাশি পদ্ম বা লোটাসের চাহিদা থাকে বেশ। প্রাকৃতিকভাবে লোটাস ফুলটি সাদা ও গোলাপি হয়। তবে ক্রেতাদের চাহিদা মাফিক আরও ১০ থেকে ১২ ধরনের রঙ করে দেওয়া হয়। তিনি জানান, দেখতে ভালো দেখায়—এই যুক্তিতে ক্রেতারা ফুলে রঙ করে দিতে বলেন।

চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন রঙয়ের স্প্রে করে দেওয়া হয় ফুলের ওপর

আলামিন বলেন, চুয়াডাঙ্গা ও যশোরের গদখালী থেকেই তারা মূলত লোটাসসহ বিভিন্ন ফুল সংগ্রহ করেন। ১০০ লোটাস কিনতে তাদের বর্তমানে খরচ পড়ছে ৪০০ টাকার মতো। ১০০ ফুলে রাসায়নিক রঙ করতে খরচ পড়ে আরও ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আর তারা বিক্রি করেন এক হাজার থেকে ১২০০ টাকায়। এই অ্যারোসল স্প্রে মূলত বোজারে ছাড়া হয়েছে ধাতব বস্তু বা কাঠের জিনিস রঙ করার জন্য, তবে এটার দেদার ব্যবহার করা হচ্ছে ফুল রাঙাতে

ফুলে কৃত্রিম রঙ ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্যগত কোনও ঝুঁকি আছে কিনা, এরকম কোনও তথ্য জানেন কিনা– প্রশ্ন করা হলে তিনি দাবি করেন, এতে কোনও সমস্যা নেই। রঙ করার পরও ফুল চার দিন থেকে এক সপ্তাহ ভালো থাকে বলেও তিনি দাবি করেন।

‘বেস্ট ফ্লাওয়ার’ নামে একটি ফুলের দোকানের কর্মী সাব্বির বলেন, গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, লোটাস ফুলের চাহিদা আছে। লোটাসে কেন রঙ করা হয় প্রশ্নে তিনি বলেন, মানুষ বিভিন্ন রঙের লোটাস চায়, এ কারণেই রঙ করে রাখি। পানি লাগলেও এই রঙ ধুয়ে যায় না। দুই থেকে তিন দিন ফুল একই রকম থাকে।

খালি হাতে এই রঙ স্পর্শ করা থেকে যে স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে সে ব্যাপারে সচেতন নন ক্রেতা-বিক্রেতাদের কেউই

অনন্যা পুষ্প বিতানের কর্মী আকেদ আহমেদ বলেন, ‘ফুল দেখতে সুন্দর দেখায়, তাই রঙ করা হয়। এতে কোনও ক্ষতি হয় না, কারণ রঙ তো শুকিয়ে যায়।’

ফুলে রঙ করতে কী ধরনের পদার্থ ব্যবহার করা হয় জানতে চাইলে তিনি ‘অ্যারোসল পেইন্ট’-এর দুটি বোতল বের করে দেখান। বোতলের গায়ে ইংরেজিতে স্পষ্ট লেখা আছে—‘কাঠ বা স্টিল জাতীয় ধাতুর ওপর, ফার্নিচার বা যানবাহন রাঙাতে এই রঙ ব্যবহার করা যাবে।’ সতর্কতা হিসেবে উল্লেখ করা আছে, ‘এটি উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ, শিশুদের কাছ থেকে এই রঙ দূরে রাখেতে হবে, মুখে বা পেটে প্রবেশ করলে দ্রুত বমি করানোর চেষ্টা করতে হবে, চোখে লাগলে দ্রুত প্রচুর পানি ঢেলে ধুয়ে ফেলতে হবে, ত্বকে লেগে ফুলে গেলে বা চুলকানো শুরু হলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।’ বর্ষার দিনে এ ধরনের স্প্রে ব্যবহার না করার নির্দেশনাও দেওয়া আছে।

ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রাজধানীর হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব অ্যারোসল পেইন্টে রয়েছে রাসায়নিক পদার্থ রেজিনসহ বেশ কিছু ক্ষতিকর উপাদান। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহারে ত্বকের ক্ষতি হতে পারে, ক্ষত বা অ্যাকজিমাসহ ত্বকের নানা রোগ দেখা দিতে পারে। এই রঙ নাকের কাছে নেওয়ার ফলে মাথা ঘোরা, মাথা ব্যথা বা বমি বমি ভাব হতে পারে। যেহেতু উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ বলা আছে পেইন্টের বোতলে, তাই গ্লাভস ছাড়া এই রঙের সংস্পর্শে এলে চামড়ায় র‌্যাশ ওঠার মতো সমস্যাও তৈরি হতে পারে। শিশুদের জন্য এটা অবশ্যই ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের রঙের সংস্পর্শে থাকলে ক্যানসারেরও ঝুঁকি রয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প বিভাগের প্রধান সাব্বির আল রাজির কাছে রাসায়নিক রঙের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘শিল্পকর্ম তৈরিতে রঙের ব্যবহার সম্পর্কে আমরা শিক্ষার্থীদের শেখাই। কাগজ, মাটি, কাঠ বা ধাতুর মতো সারফেসে কোন ধরনের রঙ ব্যবহার করা যেতে পারে, কীভাবে ব্যবহার করতে হবে—তা শেখানো হয়। ফুলের মতো প্রাকৃতিক একটি জিনিসে রঙের ব্যবহার পুরোপুরি অস্বাভাবিক একটি কাজ। শিল্পকর্ম তৈরিতে কখনও কখনও ফুল শুকিয়ে এরপর রঙ ব্যবহার করা হয়। তবে ফুল বিক্রেতারা যেভাবে জীবন্ত ফুলে রাসায়নিক রঙ ব্যবহার করছেন, এটা একেবারেই অনুচিত। এই ফুলের সংস্পর্শে এলে হাত বা শরীরের যে ক্ষতি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তারচেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে— মানুষ এই রঙের ক্ষতির বিষয়ে একেবারেই সচেতন নয়।’

অধ্যাপক ড. মো. নূরনবী

ফুলের ওপর রাসায়নিক পদার্থযুক্ত রঙের ব্যবহার বৈধ কিনা জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. নূরনবী বলেন, ‘ফুলের ওপর স্প্রে করার জন্য আলাদা এক ধরনের রঙ বা ফ্লোরাল স্প্রে পাওয়া যায়। ওই রঙে ইথানল, আইসোপ্রোপানলের মতো পদার্থ থাকে, যেগুলো মানবদেহের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। হ্যান্ডওয়াশেও এসব উপাদান থাকে। তবে ওই রঙও ফুলের ওপর স্প্রে করার পর অন্তত তিন থেকে সাত ঘণ্টা শুকাতে হয়। এরপর ওই ফুল ব্যবহার করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাতে হাত দেওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের এখানে ফুলের দোকানগুলোতে যেসব রঙ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে, সেগুলোতে টক্সিক এলিমেন্ট রয়েছে। মেটালে বা কাঠের ওপর যে রঙ ব্যবহারের কথা, সেটা ফুলের ওপর ব্যবহার করা যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘মাথায় গোঁজা, ফুলের তোড়া বা মালা বানানোর ক্ষেত্রে কারসেনোজেনিক এলিমেন্ট (ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে এরকম উপাদান) আছে— এরকম রঙ ব্যবহার করা যাবে না। এসব রঙ হাতে লাগলে ত্বকে চুলকানি, অ্যালার্জি, ফুলে যাওয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। শ্বাসের সঙ্গে হৃদযন্ত্রের ভেতরে প্রবেশ করলে অ্যাজমা হতে পারে।’

ছবি: প্রতিবেদক।