ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক না আসার ঘোষণায় অস্বস্তি আ.লীগে?

বরাবরই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে আসছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। গত দুই নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক কম বা সীমিত ছিল। তবে এবার আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। এই নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিতে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যেই ইইউ জানিয়েছে, তারা এবারও পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না। বিষয়টি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি করেছে বলে দলীয় সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। তবে দলটির নেতারা তা প্রকাশ্যে স্বীকার না করে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার অঙ্গীকারে জোর দিচ্ছেন। 

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউ পূর্ণাঙ্গ বা বড় পরিসরে পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না। ইইউর হেড অব ডেলিগেশনের বরাত দিয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় জানিয়েছে, বাজেট স্বল্পতার কারণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না ইইউ। তবে তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ‘সংঘাতের শঙ্কা’ করে সংস্থাটি পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে না বলেও বিভিন্ন সূত্রে খবর বেরিয়েছে। বলা হচ্ছে, ইইউর প্রাক পর্যবেক্ষক দলের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইইউ ছোট আকারের একটি পর্যবেক্ষক দল পাঠাতে পারে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বড় আকারে পর্যবেক্ষক পাঠালেও ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক পাঠায়নি ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এবার জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ আগেভাগে সক্রিয় হয়েছে। একদিকে ওয়াশিংটন ঢাকার ওপর নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তা প্রয়োগের প্রক্রিয়াও শুরুর কথা জানিয়েছে। অন্যদিকে তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঢাকায় প্রাক পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছিল। তাদের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনে বড় পরিসরে পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর কথা জানিয়েছে। একইপথে হাঁটতে পারে আরও কিছু দেশ ও সংস্থা, সেই শঙ্কাও রয়েছে। এটি আওয়ামী লীগের ভেতরে অস্বস্তি তৈরি করেছে।

সূত্র মতে, ইইউর এই সিদ্ধান্তকে এরইমধ্যে পুঁজি করেছে বিএনপিসহ বিরোধীরা। আওয়ামী লীগ নির্বাচনি আমেজ তৈরি চেষ্টা করছে, আর বিরোধীরা ভোট ঠেকানোর পথে হাঁটছে। এখন ইইউর ঘোষণাকে সামনে এনে তারা এর মাধ্যমে ‘দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নেই‘ বলার চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসা নীতিকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টায় লিপ্ত তারা। সামনে অন্য কোনও দেশ বা সংস্থা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক সীমিত করা বা না পাঠানোর কথা জানালে তা ক্যাশ করবে বিরোধীরা। স্বাভাবিকভাবেই এটি আওয়ামী লীগের জন্য অস্বস্তিকর হবে।

তবে এমন অস্বস্তির কোনও কারণ নেই বলে উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান। তারা বলছেন, ইইউ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠালো কি পাঠালো না, তার চেয়ে বড় বিষয় হলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা। এই অঙ্গীকার আমরা পূরণ করতে বদ্ধ পরিকর, সেটি দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বহুবার বলেছেন। তা ছাড়া আরও অনেক দেশ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে। তা ছাড়া দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষরা তো মাঠে থাকবেই।

জাহাঙ্গীর কবির নানক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনটা বাংলাদেশের। এতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে আবার নাও পাঠাতে পারে। সেই ইখতিয়ার তাদের রয়েছে। এর সঙ্গে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই। সে কারণে কারা পর্যবেক্ষক পাঠালো আর কারা পাঠালো না, তা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই।

আব্দুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কথায় কথায় এত নির্ভরশীলতা কেন? বাইরের শক্তির ওপর এই নির্ভরশীলতা তো ভালো লক্ষণ না। দেশের সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, এটা আমাদের অঙ্গীকার। সেই নির্বাচনে কারা পর্যবেক্ষক পাঠালো বা কারা পাঠালো না, সেই আলোচনা কী খুব প্রাসঙ্গিক?

শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, বিদেশি পর্যবেক্ষক আসুক আর না আসুক, আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে। আমাদের নির্বাচন কেউ পর্যবেক্ষণ করলো কি করলো না তাতে কিছুই আসে যায় না। যদি বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসেন, তাহলে তাদের স্বাগত জানাই। না এলেও কোনও অসুবিধা নেই। এটি নিয়ে বিএনপিকেও আর দেশ অস্থিতিশীল করার সুযোগ দেওয়া হবে না।

ইইউ ছোট আকারের পর্যবেক্ষক দল পাঠানোর কথা বলেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্থাটির বাজেট স্বল্পতার কথাও তারা চিঠিতে উল্লেখ করেছে। ইইউর পর্যবেক্ষক যে আকারেই আসুক বা না আসুক আমাদের দেশে ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম আছে, সার্কভুক্ত বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে আসবে। সুতরাং আমাদের নির্বাচন আমরাই করবো, আমাদের নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত নিবন্ধন পেয়েছে ৬৬টি পর্যবেক্ষক সংস্থা। গেলো একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ১১৮টি সংস্থাকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি। এবার সেই সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসায় পর্যবেক্ষক সংস্থা বাড়াতে নতুন করে আবেদনও আহ্বান করেছে ইসি। ২০০৮ সাল থেকে ভোট পর্যবেক্ষণের জন্য পর্যবেক্ষক নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে। সে সময় ১৩৮টি সংস্থা নিবন্ধন পেয়েছিল।

এদিকে, এই নির্বাচন উপলক্ষে অক্টোবরে বাংলাদেশে প্রাক নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় দেশটির দূতাবাস জানিয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এবং ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসবে। দলটি স্বাধীনভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করবে এবং বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা সে বিষয়ে সুপারিশ করবে।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তারা ভিসা নীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীনদের জন্য অস্বস্তি তৈরি করেছে। এখন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি দেখার বিষয়। তবে অস্বস্তি থাকলেও আওয়ামী লীগ জোর কদমে নির্বাচনের পথেই এগিয়ে যাবে। এতে কোনও সন্দেহের কারণ নেই।

‘পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল’ পাঠাবে না ইইউ

ইসির নিবন্ধন পেলো ৬৬ পর্যবেক্ষক সংস্থা

বাংলাদেশে প্রাক নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে যুক্তরাষ্ট্র