সাকিব ও তামিম: দোস্ত-দুশমন

‘২০২৩-এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে ঘিরে দেশ আজ দুই ভাগে বিভক্ত। একদল ক্রিকেটার সাকিবের পক্ষে, অন্যরা তামিমের। আপনি কোন পক্ষে যাবেন?’ – ক্রিকেটীয় বাণী                                

বন্ধুত্ব অন্য রকম। কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না, সহসা বিপদে ফেলতে চায় না। যেমন– এক লোক সারা রাত বাইরে ফুর্তি করে সকালে ফিরলো স্ত্রীর কাছে। দরজা খুলেই স্ত্রীর চিৎকার– সারা রাত কই ছিলে?

স্বামীর উত্তর– বন্ধুর বাড়িতে।

স্বামীকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেই স্ত্রী পরপর স্বামীর দশ বন্ধুকে ফোন দিলো। দশ জনের ছয় জন বললো বন্ধু তাদের বাড়িতেই ছিল। বাকি চার জন বললো– ও তো এখনও আমার বাসাতেই ঘুমাচ্ছে। কাঁচা ঘুম ভাঙাবো?

ক্রিকেটীয় বন্ধুত্ব সম্ভবত এমন নয়। নাবিকদের ভালোবাসা সম্পর্কে বলা হয়– সেইলরস ফ্রেন্ডসশিপ ইজ আপ টু দ্য গ্যাংওয়ে (নাবিকদের বন্ধুত্ব শিপ থেকে নেমে যাবার পথ পর্যন্ত!)

ক্রিকেটীয় বন্ধুত্ব কি তাহলে ‘আপ টু দ্য পিচ?’ বাইশ গজ পার হলেই সব শেষ?

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’ হিসেবে পরিচিত পাঁচ জনের একজন শুধু ‘ম’ ছাড়া। তিনি সাকিব আল হাসান। বাকি তিন জন ‘ম’ আদ্যক্ষরের। মাশরাফি মুর্তজা, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিম। একজনের মাঝখানে ও শেষে ‘ম’। তামিম ইকবাল। সমস্যাটা তামিম ও সাকিবকে নিয়ে! বন্ধুত্ব শেষ হয়ে শত্রুতায় রূপ নিলে যা ঘটে তা ছোটকালের কিংবা পরিণত বয়সের মতো ঘটনা।

যেমন–

এক. আরি (আর-ই) নেওয়া! (ছোটকালের ট্রেন্ড)

দুই. কথা বন্ধ! (যেকোনও বয়সে হতে পারে)

তিন. এড়িয়ে চলা কিংবা মুখ দেখাদেখি বন্ধ। (যেকোনও সময়ের ট্রেন্ড)

চার. পরিবারে এই বিভেদ ছড়িয়ে পড়া। (সাকিব আল হাসানের স্ত্রীর ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখলেই বুঝবেন!)

পাঁচ. কিছু কিছু গান শুনতে ইচ্ছে হয়। যেমন– বন্ধু তুমি শত্রু তুমি/তুমি আমার সাধনা/তোমার দেয়া আঘাত আমায় দেয় যে মধুর যন্ত্রণা… অথবা

বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম/তবু একটা কিছু হয়েছি যে তাতেই আমি ধন্য হলাম…

সুতরাং এই ট্রেন্ড তামিম ও সাকিবের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ২০২৩-এর অক্টোবরে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি বা অনুশীলনেও তারা মুখোমুখি হননি বললে চলে। এমন যে আগে হয়নি তেমন নয়। আগেও এমন হয়েছে, তবে বন্ধুত্বে ভাঙন ধরেনি। বেশ কিছু দিন তারা কথাও বলেননি। কোনও এক জানুয়ারিতে শ্রীলংকার বিপরীতে সাকিব ৯২ রান করে বাংলাদেশকে জেতালে তামিম তাকে জড়িয়ে ধরায় কেঁদেছিলেন দুজনই। সেটা স্মৃতি হয়ে আছে।

বিশ্বকাপের ভাঙন তাদের দুজনকে একেবারেই আলাদা করে দেবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ, একটা জনপ্রিয় দৈনিক একসময় সাকিবকে দিয়ে কলাম লেখাতো। বিষয় তারাই ঠিক করে দিতেন। একটি মাত্র কলামের বিষয় নিজেই ঠিক করেছিলেন সাকিব আল হাসান। সেই কলামে তিনি লিখেছিলেন তামিম ইকবালকে নিয়ে। লেখার খানিক অংশ এমন-

‘তামিমের ভেতরে আমি এমন কিছু পেয়েছি, যা খুব কম মানুষের ভেতর পেয়েছি…গত মৌসুমে মোহামেডানে ইমন নামে একজন পেস বোলার ছিল। কোনো এক ম্যাচের আগে তামিম ইমনকে বলেছিল ভালো খেললে সে আইফোন কিনে দেবে এবং কিনেও দিয়েছিল। …অনুশীলনের সময়ে তামিম প্রায়ই গ্রাউন্ডসম্যানদের নিয়ে সেন্টার উইকেটে বিগ হিটের প্র্যাকটিস করে। এই প্র্যাকটিসে যে তাকে আউট করতে পারে কিংবা ক্যাচ নিতে পারে, তামিম তাকে এক হাজার পাঁচশ করে টাকা দিতেই থাকে!..এছাড়া হঠাৎ করে কারও কোনও বড় সাহায্য লাগলে তামিম সবার আগে এগিয়ে আসে। আমি দেখেছি ও এসব করলেই ভালো খেলে’।

এটা যদি তামিম সম্পর্কে সাকিবের একসময়ের ভাষ্য হয় তাহলে বন্ধুত্বে সমস্যা হবার পর নতুন মূল্যায়ন কেমন? তার আগে যদি সাত হাজারের বেশি রান করা এবং তিনশ’র বেশি উইকেট পাওয়া সাকিব মাঠ ও মাঠের বাইরের যেসব কারণে খবরের শিরোনাম হয়েছেন সেগুলোর দিকে নজর দেই তাহলে কেমন হবে?

সাকিবের এসব কীর্তিকলাপ নিয়ে বহু পত্রিকায় লেখা হয়েছে এবং আমি নিজেও লিখেছি। যেমন-

এক. সাকিব আবাহনী মোহামেডানের মতো ম্যাচে আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে লাথি মেরে উইকেট ভাঙতে পারেন।

দুই. আম্পায়ার বৃষ্টির জন্য খেলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিলে সাকিব নিজ হাতে উইকেট উপড়ে ফেলতে পারেন। তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ এবং লাখ টাকা জরিমানা হলেও কিছু যায় আসে না।

তিন. জুয়াড়িদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডকে না জানানোর অপরাধে এক বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হন।

চার. ভক্তের মোবাইল ফোন ভেঙে ফেলা, গ্যালারিতে গিয়ে হুমকি, টেস্ট খেলতে না চাওয়া, ফটোসেশন না করা, এমনকি ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার রেকর্ড আছে সাকিবের। বোর্ডকে না জানিয়ে ক্যারিবীয় দীপপুঞ্জে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার একমাত্র রেকর্ডও সাকিবের।

ব্যক্তিগত কিছু বিষয় বাদ দিয়ে বলা যায়, মাঠের বাইরেও সাকিব সমান বিতর্কিত। যেমন–

এক. বিদেশের বিভিন্ন লীগ ও ক্লাবে খেলেছেন সাকিব। টাকা দেশে আনেননি বলে কয়েকটি দৈনিকে রিপোর্ট ছাপা হয়েছে। এটা কি মানি লন্ডারিং? মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধে এ দেশে ১২ বছর জেল খাটার নজিরও আছে।

দুই. মোনার্ক হোল্ডিংস-এর চেয়ারম্যান হিসেবে সাকিব শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের কথা জানিয়েছিলেন। যেটা জানাননি, পত্রিকার ভাষ্য অনুযায়ী সেটা হচ্ছে মোনার্ক হোল্ডিংসের অন্য অংশীদাররা শেয়ার কেলেঙ্কারির দায়ে অভিযুক্ত এবং তাদের জরিমানাও করা হয়েছে।

তিন. জুয়া ও ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত বেটিংয়ের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘বেটউইনার নিউজে’র শুভেচ্ছাদূত হয়েছিলেন তিনি। পরে ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড শক্ত অবস্থান নিলে এই চুক্তি থেকে সরে আসতে বাধ্য হন সাকিব।

চার. সাকিবের আমেরিকায় বাড়ি কেনা আর সৌদি আরবে হোটেল ব্যবসায় জড়িত হবার পর একটি জনপ্রিয় দৈনিকের প্রশ্ন ছিল– সাকিবের এসব সম্পদ কি তার করের হিসাববহির্ভূত? মাগুরাতে সাকিব একবার কুচের খামার করেছিলেন। জমির মালিকদের টাকা দেননি বলেও অভিযোগ উঠেছিল তখন।

বন্ধুত্বে সমস্যা হওয়ার পর নতুন মূল্যায়ন কেমন? বিভিন্ন পত্রিকা ও অনলাইন ঘেঁটে যা পাওয়া গেছে তা এমন–

এক. মোমিনুল টেস্ট ক্যাপ্টেন ছিলেন। সাকিব ক্যাপ্টেন হবার পর মোমিনুল দল থেকে বাদ পড়েন।

দুই. তামিম ওয়ানডে ক্যাপ্টেন ছিলেন। সাকিব ক্যাপ্টেন হবার পর তামিম বাদ।

তিন. মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ টি-টোয়েন্টি দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। এর পরেরটুকু শূন্যস্থান পূরণ করুন…

এবার বিশ্বকাপ দল থেকে তামিম বাদ পড়ার পর–

এক. তামিম ১২ মিনিটের একটা ভিডিও আপ করেছেন। সেটা খুবই আবেগী কিন্তু ভদ্রতা ক্ষুণ্ন করেননি। হয়তো ব্যাটিং লাইনআপ পছন্দ হয়নি বলে আবেগের চূড়ান্তে উঠে খেই হারিয়ে ফেলেন। আবেগী সিদ্ধান্ত না হলে পাঁচ ছয় নম্বরে হয়তো তামিম ব্যাট করতে পারতেন, যা ২০২৩ বিশ্বকাপে আর সম্ভব হয়নি। সাকিবকে ইঙ্গিত করে কোনও কথা বলেননি।

দুই. সাকিব পত্রিকা, বিবিসি এবং একটা স্পোর্টস চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ‘আমি দল সিলেকশনে নেই’ বলার পরও ইঙ্গিতে তামিমের ফিট না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির একটা মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যার সারমর্ম এই– যে ফিট না থেকেও খেলে সে আসলে দেশ ও দলের সঙ্গে প্রতারণা করে। দেশ ও দলের স্বার্থে ছয় বা সাত নম্বরে ব্যাট করার কথাও বলেছেন…

তামিম ও সাকিবের বন্ধুত্ব অনেক পুরোনো। তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৯৯ সালের দিকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটা ক্যাম্পে। এরপর তারা অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে সুযোগ পেলে তামিম ও সাকিবের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়। তারা একই ভবনে বহুদিন পরিবার নিয়েও থেকেছেন।

পুরোনো রেকর্ড বাদ দিলেও সাকিব নতুন করে বিতর্কিত কাজ করেছেন। দল বিদেশে থাকাকালীন দেশে এসে শোরুম উদ্বোধন করে আবার দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। দলের সঙ্গে বিদেশ যাওয়ার আগে এয়ারপোর্টে যাওয়ার সময়ও বিজ্ঞাপনের কাজ করেছেন। তামিম সাকিবের পরিবারে নাকি এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারেও কথা ও সমালোচনা হয়েছে। তবু সব কিছুর শেষে সাকিব মাঠের পারফরম্যান্সে ঠিকই নিজেকে মেলে ধরতে পেরেছেন। যারা সাকিবের পক্ষে তারা বলছেন– সাকিব সব জবাব দেয় মাঠে। কারও মতো খুঁড়িয়ে চলে না।

কিন্তু পুরোনো কথা তামিমের পক্ষের লোকজনও ভোলেননি। লর্ডসের মাঠে সেঞ্চুরি করার পর তামিম দুই হাত দিয়ে বই এঁকে বুঝিয়েছিলেন– ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে। একবার দলে ফিরে পর পর তিন ম্যাচে হাফসেঞ্চুরি করার পর মাঠে আঙুল গুনে বুঝিয়েছিলেন তিনি ফিরে এসেছেন।

হয়তো তামিম আর দলে ফিরবেন না। হয়তো চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাসে ঢাকা পড়ে যাবে এসব স্মৃতি। দুঃখ এই যে দল কিংবা খেলার উন্মাদনা ছাপিয়ে তামিম সাকিবের বন্ধুত্বে ভাঙনের ঘটনা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ছড়িয়েছে। সাবেক ক্রিকেটার ও জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার হার্শা ভোগলেও এটা নিয়ে মন্তব্য করেছেন। করেছেন আরও অনেকে।

কেউ কেউ বলেন বন্ধুত্বের অস্তিত্ব থাকে গল্প, উপন্যাস, কবিতা কিংবা চলচ্চিত্রে। বাস্তবের বন্ধুদের কেউ কেউ অনেক সময় মীর জাফর আলী খান বা খন্দকার মোশতাকের মতো হয়। এ দেশে ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিটা নির্মিত হয়েছিল হিন্দি ‘শোলে’ ছবির আদলে। রাজা ও ভীরু শেষমেশ ডাকাত গাব্বার সিংকে ঘায়েল করতে নামলে একজন মারা যায়। তার আত্মাহুতির ভেতর দিয়ে শান্তি নেমে আসে।

আমরা শান্তি চাই, ক্রিকেট ভালোবাসার মতো বন্ধুত্বের গল্পও অমর করে রাখতে চাই। নদীভাঙনের দেশে বন্ধুত্ব না ভাঙুক। পাকিস্তান আফগানিস্তানের মতো অশান্ত দেশে ক্রিকেট ঐক্য অটুট রাখে। আমরা ভালোবাসা এবং ক্রিকেটে শান্তি ও ঐক্য চাই।

জয় পরাজয়ের আনন্দ বা বেদনায় আমাদের বিভাজন না হোক, বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। তামিম ও সাকিবের আলাদা হওয়া একদিন মিটেছিল শ্রীলংকার সঙ্গে জয়ের পর, দুজনার কোলাকুলিতে। এবার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ভালো করুক বাংলাদেশ। ক্রিকেট দল দেশে ফেরার পর সবাইকে বুকে জড়িয়ে আনন্দ অশ্রু ফেলবেন তামিম, সেই কামনা রইলো। তামিম বরাবরের মতো সাকিবের কাছে জানতে চাইবেন–একদিনের ক্রিকেটে কয়টা হানড্রেড মেরেছিস? বল সাদা ড্রেসে কয়টা?

আমরা বন্ধুত্ব ফিরিয়ে আনা একটা বিজয়ের গল্প শুনতে চাই।

লেখক: রম্যলেখক