বিশ্বকাপে কী পাওয়ার কথা ছিল, কী পেলো বাংলাদেশ?

একবার কল্পনা করুন তো, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গভীর রাতে মৃদুমন্দ শীতের আগমনী বার্তার মাঝে সমর্থকদের বেজায় ভিড়। সবার হাতে বাহারি রঙয়ের ফুল। সেই সঙ্গে ব্যানার-ফেস্টুনও অন্ধকারে উঁকি দিচ্ছে। সবারই তীব্র বাসনা, সাকিব আল হাসানের দলকে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত করে নেওয়া। ভারতের বিশ্বকাপে যেমনটি চেয়েছিল, ঠিক তেমনটি করতে পেরে বাংলাদেশ দলের দেশে ফেরার মাহেন্দ্রক্ষণটা জম্পেশভাবে সাজিয়ে রাখার পরিকল্পনা।

মনের কল্পনাতে এমন কিছু হয়তো সাজিয়ে রাখলে রাখতে পারতেন, ভাবনাতে তো অনেক কিছুই থাকে। তবে তা এখন শুধু  কল্পনাতেই অপমৃত্যু ঘটেছে। বাস্তবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার মতো তেমন কিছুই করতে পারেননি সাকিবরা। ক্রিকেট দলের সাফল্যগাঁথা যে ফানুসের মতো আগেই দূর আকাশে উবে গেছে! আজ রাতে বিমানবন্দরে সেই কল্পনার তুলির আঁচড় পড়ার কোনও সম্ভাবনাই উঁকি দিচ্ছে না। নিশ্চিতভাবে নিভৃতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে।

অথচ এমনটি আগে কি হওয়ার কথা ছিল? বিশ্বকাপ শুরুর আগে কতশত স্বপ্ন-প্রতিশ্রুতি। কথায় রয়েছে বাঙালি মানে আবেগপ্রবণ। সাকিবদের পারফরম্যান্সের প্রতিশ্রুতিতে বড়সড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। ১৯৮৬ সাল থেকে ওয়ানডে ম্যাচ খেলতে থাকা বাংলাদেশ দলের টানা সপ্তম বিশ্বকাপে এমন ভরাডুবি কে ভাবতে পেরেছিল?

যেখানে আগের আসরগুলোতে দারুণ কিছু পারফরম্যান্স ছিল। এবার তো বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব নিজেই বড় স্বপ্ন দেখানোর ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন। দলের প্রতি ভরসা রাখতে বলেছিলেন। তারুণ্য ও অভিজ্ঞদের মিশেলে দারুণ এক দল হয়ে ওঠার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অন্যভাবে পরিচিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ৯টি ম্যাচের মধ্যে মাত্র দুটিতে জয়। শুরুটা আফগানিস্তানের বিপক্ষে দিয়ে দারুণভাবে হলেও এরপর শুধুই ভরাডুবির কাহিনী। আজ শক্তিধর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হারের আগের ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে ছিল সবশেষ জয়। তাও আবার সেই ম্যাচে টাইমড আউটের নজিরবিহীন ঘটনা নিয়ে ক্রিকেট বিশ্ব তোলপাড়। সেই ঘটনায় সাকিবের সমালোচনাটা একটু বেশি হচ্ছে।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে সেমিফাইনালের স্বপ্ন দেখানো ও সমর্থকরা যখন তা বিশ্বাস করেছিল শুধু সাকিব আছেন বলেই। শুরুর আগে তামিম কাণ্ড কিংবা দল নিয়ে বেশ হইচই হলেও তা কোনোভাবেই পাত্তা দিতে নারাজ ছিলেন সাকিব। বরং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন শতগুণ। ভারতের মাঠে আত্মবিশ্বাসের সেই ছায়া সেভাবে দেখা যায়নি। সব যেন তছনছ হয়ে গেলো। কিছুতেই কিছু কাজ হয়নি।

দুঃস্বপ্ন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ‘পুচকে’ নেদারল্যান্ডসের কাছে হার। ব্যাটিং কিংবা বোলিংয়ে এসে ধারাবাহিকভাবে কেউ সফল হতে পারেনি। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলতে হলে নিজেদের সেভাবে মেলে ধরতে হবে, উদ্ভাসিত নৈপুণ্য দেখাতে হবে; তা যেন প্রায়ই ভুলে গিয়েছিল অনেকেই!

বিশ্বকাপে যখন তলানির দিক দিয়ে ওপরে থাকার লড়াইয়ে শামিল বাংলাদেশ, এর মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির যোগ্যতার মাপকাঠির ঘোষণাটি যেন চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারতের মাঠে সেমিফাইনাল স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ, সেই শোকের মাঝে কিনা তলানির ঠিক ওপরে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় ২০২৫ পাকিস্তানের আসরে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তুমুল লড়াই!

বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল স্বপ্ন ভুলে এখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলার বড় আশা দেখছে বাংলাদেশ। আপাতত নিজেদের কাজটুকু সেরে রেখেছে। কাল ভারত-নেদারল্যান্ডস ম্যাচে বড় কোনও অঘটন না হলে হয়তো  পাকিস্তানে যাওয়ার সুযোগটা করে নিতেই পারবে সাকিব-তাসকিনরা।
আর তাহলে হয়তো অনেকই খুশি হবেন। খুশি হওয়ারই কথা। অন্তত বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে তো বাংলাদেশ থাকলো! তবে খুশির মাঝে বিশ্বকাপে হারের আঘাতে গভীর ক্ষতের কথা কি ভোলা যায়?

একটা কথা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। সাফ চ্যাম্পিয়ন নারী দলের অন্যতম সদস্য সানজিদা আক্তার সাকিবদেরও বিশ্বকাপ শেষে ছাদখোলা বাসে করে দেশের মাটিতে দেখতে চেয়েছিলেন। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে এমন প্রত্যাশা রেখেছিলেন সবার প্রতি, যেন সেভাবেই পারফর্ম করে ক্রিকেটাররা।

সবার আশা গুড়েবালি করে হতাশার এক বিশ্বকাপ শেষ হলো। আগে-পরে একের পর এক বিতর্ক এর সঙ্গী। কিছুদিন এমন হতাশায় দিন যাবে। দলে হয়তো কিছু পরিবর্তন হবে। খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা থাকবে। সবকিছু তাজা তাজা থাকতে নতুন কিছুর ঘনঘটা। এর ধারাবাহিকতায় ২০২৭ সালের বিশ্বকাপ নিয়ে আবারও সমর্থকরা স্বপ্ন বুনবেন। তখন হয়তো সাকিবসহ অনেকেই থাকবেন না। তবে নতুন যারাই থাকবেন তাদের প্রতি শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে সবশেষ ভারতের বিশ্বকাপটি। অন্তত ইতিবাচক কিছু স্বপ্ন দেখানোর আগে এখন থেকেই নিজেদের সেভাবেই তৈরি করে নেওয়ার। যেন  চার বছর পরের স্বপ্ন সলিল সমাধি না হয়!