শীত শীত পড়েছে। পূর্বিতার নাক দিয়ে ক্রমাগত জল পড়ছে । আর এই সময় নাক দিয়ে জল পড়লে স্বাভাবিকভাবে যেটা ভাবার কথা পূর্বিতাও সেটাই ভেবেছেন। সিজ়ন চেঞ্জ, ঠান্ডা লেগেছে আর কী ! তাই হয়ত কাঁচা জল পড়ছে। কিন্তু নাক দিয়ে তরল বের হওয়া ছাড়া সর্দি-কাশির আর কোনও লক্ষণই দেখছেন না পূর্বিতা। ১ সপ্তাহ, ২ সপ্তাহ যায়…কিন্তু পূর্বিতার নাক দিয়ে তরল নিঃসরণ আর থামছে না। সর্দি নেই, কাশি নেই, শুধুই নাক থেকে জল ঝরছে ! এটা কি সত্যিই ঠান্ডা লাগার লক্ষণ ? চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পূর্বিতা জানতে পারলেন, সর্দি-গর্মি কিছুই না, এই লক্ষণের পিছনে কারণটা বেশ জটিল । অনেকগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল তা।
অনেকেই নাক দিয়ে জল পড়ার সঙ্গে সরাসরি মিলিয়ে দেন ঠান্ডা লাগাকে। কিন্তু এতটা সরলীকরণ করে ভাবাটা ঠিক নয়, বলছেন চিকিৎসকরা। নাক দিয়ে তরল বের হওয়ার বিষয়টি যদি দীর্ঘকাল ধরে চলতেই থাকে, তাহলে একবার ভাবা দরকার। নাক-কান-গলার চিকিৎসকরা, অর্থাৎ ই.এন.টি-রা এরকম অনেকগুলি কারণ বের করেছেন এই লক্ষণের পিছনে। এই নিয়ে এবিপি লাইভের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন চিকিৎসক মনোজেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য (Dr Manojendra Narayan Bhattacharyya, Senior Consultant Surgeon, Department of ENT Head & Neck Surgery, Peerless Hospital Kolkata)।
নাক দিয়ে জল পড়াটা কোনও অসুখ নয়, অসুখের লক্ষণ মাত্র। এবার নানা কারণে নাক দিয়ে জল, জলের মতো তরল বের হতে পারে। কোনও কোনও রোগের ক্ষেত্রে রক্ত, অন্য রঙের তরলও বের হয়। চিকিৎসকরা প্রথমে কয়েকটি প্রশ্ন করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, এই নাক দিয়ে জল পড়ার কারণটা ঠিক কী কী হতে পারে। সেই অনুযায়ী পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়। খুঁজে দেখা হয় উপসর্গের কারণ। জানালেন চিকিৎসক মনোজেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য ।
কিছু প্রশ্ন রোগীকে করা হয়
– তিনি গন্ধ পাচ্ছেন কিনা
-কোনও ব্লকেজ অনুভব হচ্ছে কি না
– ব্যথা আছে কি না
– নাকে কোনও ব্যথা আছে কি না
– নাক চোখ দিয়ে জল পড়ছে কি না
– নাকের কোনও সার্জারি হয়েছে কি না ইত্যাদি
এই প্রশ্নগুলির উত্তরের উপর ভিত্তি করেই ডাক্তাররা কিছু পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কী কী পরীক্ষা করা হয়
– আলো দিয়ে নাক – কান- গলা ও গলার বহিরাংশ দেখা হয়
– নাকের ভিতরে স্পেশ্যাল ক্যামেরা দিয়ে নাকের এন্ডস্কপি ( Nasal Endoscopy ) করানো হয়। এর আবার দুটি ধরন হয় । rigid এবং flexible ।
এতে করে বোঝা যায় ঠিক কী কী কারণে এই উপসর্গ দেখা যেতে পারে। সঙ্গে রক্তপরীক্ষা, ইমেজিং ( স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি) করা হতে পারে। তাতে নিশ্চিত হওয়া যায় নাকের মধ্যে কোনও মাংসল গ্রোথ হয়েছে কি না। যেমন – টিউমর বা পলিপ জাতীয় কিছু। যদি থাকে, তাহলে তা বায়পসির জন্য পাঠানো হয়ে থাকে।
কী কী কারণে নাক দিয়ে ডিসচার্জ হতে পারে
- সর্দি-গর্মির কারণে
- অ্যালার্জিক রাইনাইটিস
কী কী কারণে হতে পারে
- অ্যালার্জিক রাইনাইটিস অ্যালার্জেন নাকের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সমস্যা তৈরি হতে পারে। একটি খুব সাধারণ সমস্যা। এটা ধুলো বালি থেকে হয়।
- ফুলের রেণু থেকে হতে পারে।
- পেট্রোল-ডিজেলের ধোয়া থেকে হতে পারে।
- পোষা প্রাণীর চুল থেকে হতে পারে।
- দূষণ থেকে হতে পারে।
- কাশ ফুল থেকে হতে পারে।
- কনস্ট্রাকশন সাইট থেকে ভেসে আসা ধুলো থেকে হতে পারে।
- ধানের মড়াই হওয়ার সময় হতে পারে।
- বাথরুমে বা রান্নাঘরে জমা শ্যাওলা থেকে হতে পারে।
- কাপাস তুলো থেকে হতে পারে।
- অনেক সময় আবহাওয়ার প্রভাবেও এই সমস্যা হতে পারে।
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে কী কী উপসর্গ
– কাশি
-গলা ব্যথা
– ঠাণ্ডা লাগা
– বারবার মাথাব্যথা
– চোখের নিচে কালো দাগ
– অতিরিক্ত ক্লান্তি
- অ্যালার্জি থেকে অ্যাজ়মা হতে পারে।
- নাকে কোনও টিউমর হলেও এই সমস্যা দেখা যায়। নাকের তরলের ধরনও বদলে যায় কারণের উপর ভিত্তি করে।
- নাকের মধ্যে কোনও কিছু ঢুকে গেলে।
- এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হল Cerebrospinal Fluid লিক করা। Cerebrospinal fluid (CSF) কী? নাকের ঠিক উপরেই থাকে ব্রেন, যা ভাসে এই ফ্লুইডের উপর। সেটিই হল Cerebrospinal Fluid। বলে। এবার নাকের ছাদ ও ব্রেনের মেঝে হল একটি পার্টিশন। তাতে কোনও কোনও উইক স্পট থাকে। সেখানে যদি কোনও ফাটল তৈরি হয়, তাহলে সেখান দিয়ে ওই ফ্লুইড লিক করে নাক দিয়ে বেরোতে থাকে। তাকে বলে CSF রাইনোরিয়া। এই ফ্লুইড সাধারণ একদিক দিয়েই বের হয়। এই ফাটলটা মেরামত করতে হয়, ঠিক যেমনটা বাড়ির ছাদ ফেটে গেলে চুন-সুড়কি দিয়ে মেরামত করতে হয়, তেমনটাই আর কী।
কীভাবে ব্রেনের মেঝেতে ফাটল ধরে ?
- কোনও দুর্ঘটনার কারণে এটি ঘটতে পারে।
- খুব জোরে নাক ঝাড়লে এমনটা ঘটতে পারে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন, এই তরল বের হলে কী কী হতে পারে। কীই বা ক্ষতি হয়। এর ব্যাখ্য়াও দিলেন চিকিৎসক মনোজেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য । তিনি জানালেন, নাকের ছাদ বাইরে থেকে আসা ধুলো-বালি থেকে রোগজীবাণুকে মস্তিষ্কে পৌঁছতে দেয় না। ঢালের মতো রুখে দেয়। এবার এই ঢালেই যদি ফাটল থাকে, আর তার কোনও চিকিৎসা না হয়, তাহলে সেখান দিয়ে কঠিন অসুখের জীবাণু পৌঁছে যেতে পারে সরাসরি মস্তিষ্কে। আর তা থেকে ভয়ানক অসুখ করতে পারে। যেমন মেনিনজাইটিস (meningitis)। আর এই অসুখ যে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে, তা তো অনেকেরই জানা । অনেক সময় বারবার মেনিনজাইটিস হলে নিউরোসার্জেনরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই সমস্যা দেখলে ইএনটি-দের কাছে পাঠান।
অনেকেই জানতে চান, CSF লিকের চিকিৎসা কী ?
- চিকিৎসকরা বলছেন, প্রথমেই যে সার্জারির দিকে যেতে হয় এমন কিন্তু নয়। প্রাথমিক স্তরে রোগীর প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রেখে, মাথা না ঝুঁকিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। হালকা লিকের ক্ষেত্রে এসব করেই সামলে যেতে পারে। সমস্যা নিজে থেকেই সারে।
- এবার তাতে কাজ না যদি হয়, তখন সার্জারির দিকে যেতেই হয়। লিক বড় হলে অপারেশন করতেই হয়। ইএনটিরা এন্ডোস্কপি পদ্ধতিতে নাক দিয়ে গিয়ে ছাদ সারান।
সাধারণত, নাকের একদিক দিয়েই তরল বের হয়। আবার দুইদিক দিয়েও হতে পারে খুব কম ক্ষেত্রে। চিকিৎসক মনোজেন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্যের দাবি, ইনএনটি দ্বারা সম্পাদিত এই পদ্ধতিতে অনেক দ্রুত সারানো যায় রোগীকে। তাই নাক থেকে জল পড়লে কখনই অবহেলা করা ঠিক নয়। ঘন ঘন নাক দিয়ে তরল বের হলে, তা দীর্ঘদিন অবধি স্থায়ী হলে তা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিতেই হবে।
আরও পড়ুন : HIV পজিটিভ মানেই কি জীবন শেষ ? নিশ্চিত মৃত্যু? বিপ্লব এনেছে ART
Check out below Health Tools-
Calculate Your Body Mass Index ( BMI )
Calculate The Age Through Age Calculator