বারবার কয়লা-সারবাহী নৌযানডুবি, হুমকিতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য

মোংলা বন্দরের পশুর নদে পণ্য নিয়ে একের পর এক ডুবছে কার্গো জাহাজ। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে? কখনও জ্বালানি কয়লা, কখনও সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার, আবার কখনও বিষাক্ত সার নিয়ে ডুবে যায় এসব কার্গো। এসব ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। ডুবে যাওয়া জ্বালানি, কয়লা, ক্লিংকার বা সার নদের জলজ প্রাণীর পাশাপাশি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশবিদদের উদ্বেগের মধ্যেই গত ১৭ নভেম্বর ৮০০ টন কয়লা নিয়ে পশুর নদে ডুবে যায় একটি কার্গো জাহাজ। এর আগে ১৬ অক্টোবর ক্লিংকার নিয়ে ওই নদের চার নম্বর বয়া এলাকায় ডুবে যায় আনমনা-২ নামে একটি কার্গো জাহাজ।

একই এলাকায় ২০২২ সালের ৫ মার্চ ৬০০ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় এমভি নওমী নামের আরও একটি কার্গো জাহাজ। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ৭০০ টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি বিবি-১১৪৮’ ডুবে যায় নদের বানিশান্তা এলাকায়। একই বছরের ৫ মার্চ ৫০০ টন কয়লা নিয়ে ক্রিক বয়ায় ডুবে যায় ‘ইফসিয়া মাহী’ কার্গো জাহাজ। ৮ অক্টোবর নদের চিলা এলাকায় ড্যাপ সার নিয়ে ডুবে যায় ‘এমভি দেশবন্ধু’ কার্গো জাহাজ। ১৫ নভেম্বর ‘এমভি ফারদিন-১’ ডুবে যায় ৬০০ টন কয়লা নিয়ে। ২০১৮ সালের ১৫ এপ্রিল ৭৭৫ টন কয়লা নিয়ে ডুবে যায় ‘এমভি বিলাস’ কার্গো। তার আগে ২০১৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ৭০০ টন কয়লা নিয়ে ‘এমভি আইজগাতি’ কার্গো ডুবে যায় মোংলা বন্দরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডুবন্ত জাহাজ থেকে সঠিক সময়ে কয়লা উত্তোলন না হওয়ায় কয়লার বিষাক্ত কেমিক্যাল নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। এতে পশুর নদের পাশের সুন্দরবন এবং তার আশপাশের এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল্লাহ ইউসুফ হারুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রতিবছরই কয়লা বা সার নিয়ে নৌযান ডুবলেও কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। কয়লায় কার্বন আর সালফার আছে। ওই কয়লার কারণে নদীতে কার্বনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর সালফার পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করে। যেটি জলজ প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাণীদের বাসস্থান এই নদের তীরের সুন্দরবন। তাই এর প্রভাব সুন্দরবনেও পড়তে পারে। কার্বনের কারণে বড় গাছ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছ ও লতাপাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মো. নুর আলম শেখ বলেন, ‘পশুর নদ দিয়ে কয়লা বহনের বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছি। এই নদের তীরেই সুন্দরবন। এই নদে এর আগে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজও ডুবেছে। এর ফলে এখানকার পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে আছে।

‘সার বা ক্লিংকার নিয়ে ডুবে যাওয়া নৌযানগুলোর অধিকাংশেরই ফিটনেস নেই। ফিটনেস না থাকায় কয়েক দিন পরপরই পশুর নদে কার্গো জাহাজডুবির ঘটনা ঘটে। এগুলো যাদের দেখার দায়িত্ব তারা দেখেন না।’

এ বিষয়ে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার ক্যাপ্টেন শাহীন মজিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অদক্ষ চালক, ফিটনেস নেই, সার্ভে সনদ না থাকা, অতিরিক্ত পণ্যবোঝাইসহ নানা কারণে নৌযানডুবির ঘটনা ঘটছে। নৌযান মালিকপক্ষ বা এসব দেখা যাদের দায়িত্ব তারা ঠিকমতো পদক্ষেপ নিলে এসব দুর্ঘটনা কমবে।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা তো আইন প্রয়োগকারী সংস্থা না। এ ব্যাপারে শিপিংয়ের ডিজি আইনগত ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া নৌযান মালিকপক্ষকে ডেকে এসব ঘটনা কেন ঘটছে, সে জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’

নৌযানডুবির বিষয়ে চালকদের গাফিলতি রয়েছে স্বীকার করে নৌপরিবহন অধিদফতরের প্রকৌশলী ও শিপ সার্ভেয়ার (খুলনা) মাশরুফ আহমেদ বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। ফিটনেস না থাকা ও চালকদের গাফিলতির বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মাস্টার-ড্রাইভারদের বিরুদ্ধে মেরিন কোর্টে মামলাও হয়েছে। এ ছাড়া এটি দেখা শুধু আমাদের দায়িত্ব না, বন্দর কর্তৃপক্ষ, কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশেরও দায়িত্ব আছে।’

সবাই সম্মিলিতভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখলে নৌদুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।