রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টির বিপর্যয়, যা বলছেন নেতাকর্মীরা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগে জাতীয় পার্টির (জাপা) দুর্গে চরম বিপর্যয় ঘটেছে। রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে এবং পুরো বিভাগের ৩৩টি আসনের মধ্যে মাত্র তিনটিতে জাপার প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। অধিকাংশ আসনে প্রার্থীরা জামানতও হারিয়েছেন। এমন পরাজয়ের কারণ হিসেবে নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো না থাকা, রাজনৈতিকভাবে সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি, দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিসহ নানা কারণে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত দলটির জনপ্রিয়তা কমে এসেছে।

এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন সমঝোতার কারণে জাপাকে ছাড় দেওয়া হয় ২৬ আসন। তার মধ্যে রংপুর বিভাগে ছিল নয়টি। এর মধ্যে মাত্র তিনটি আসনে জয়ী হয়েছেন জাপার প্রার্থীরা। তারা হলেন– রংপুর-৩ আসনে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এবং কুড়িগ্রাম-১ আসনে এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান। বাকি ছয় আসনের জাপা প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

ওই ছয়টি আসনের মধ্যে নীলফামারী-৩ আসনে রানা মোহাম্মদ সোহেল, নীলফামারী-৪ আসনে আহসান আদেলুর রহমান, রংপুর-১ আসনে হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ, কুড়িগ্রাম-২ আসনে পনির উদ্দিন আহমেদ, গাইবান্ধা-১ আসনে শামীম পাটোয়ারী এবং গাইবান্ধা-২ আসনে মো. আব্দুর রশিদ পরাজিত হয়েছেন।

লালমনিরহাট সদর আসনে জিএম কাদের এর আগে দুবার সংসদ সদস্য থাকলেও এবার ওই আসনটি জাপার হাতছাড়া হয়ে গেছে। পরাজিত হয়েছেন জাপা প্রার্থী।

গাইবান্ধাও একসময় জাতীয় পার্টির শক্ত ঘাঁটি ছিল। এবার এ জেলার পাঁচটি আসনের দুটিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হলেও গাইবান্ধা-১ আসনে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও গাইবান্ধা-২ আসনে আব্দুর রশিদ সরকার পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ আর স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে।

একই অবস্থা নীলফামারীতেও। এ জেলার চারটি আসনেই ভরাডুবি হয়েছে জাপার। এরশাদ পরিবারের সদস্য ও বর্তমান এমপি আহসান আদেলুর রহমানকে আওয়ামী লীগ ছাড় দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি। নীলফামারীর চারটি আসনে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দুটি করে আসনে জয়ী হয়েছেন।

অপরদিকে, কুড়িগ্রামের চারটি আসনের মাত্র একটি আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান জয়ী হয়েছেন। বাকি তিনটির দুটিতে আওয়ামী লীগের নৌকা, একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। জেলার চারটি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দুটি আসনে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলেও একটি আসন ছাড়া সব আসনে জাপা প্রার্থীরা পরাজিত হয়েছেন।

জাপার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর তাকে গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা, নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার চেষ্টা, মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেওয়াসহ বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার পক্ষে রংপুর জেলায় গণবিস্ফোরণ ঘটে। ফলে সরকার বাধ্য হয় তার মনোনয়নপত্র বহাল রাখতে। সেই আন্দোলনের ঢেউ পুরো রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে এরশাদ দুবার রংপুরের পাঁচটি আসনে প্রার্থী হয়ে সবগুলোতেই জয়ী হন। শুধু তাই নয়, রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলার ২২টি আসনেই জয়ী হন জাপার প্রার্থীরা। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো না থাকা, রাজনৈতিকভাবে সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তির অভিযোগে সাধারণ মানুষের মাঝে দল সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হওয়া, দলের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নামা শুরু হয়। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দলটির রাজনৈতিক বিলুপ্তি ঘটবে।

২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার সমঝোতা হয়। গঠিত হয় মহাজোট। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টিকে ৩২ আসন ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সালের নির্বাচনে আবারও মহাজোটে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা। সেই নির্বাচনে জাপার প্রার্থীরা সারা দেশে ২০টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেন। এবং আরও ১৩টি আসনে জয়ী হয়ে মোট ৩৩টি আসনে নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একই ভাবে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে জাতীয় পার্টিকে দেওয়া হয় ২৯টি আসন। তারা ২২টি আসনে জয়লাভ করে। এভাবেই তাদের আসন সংখ্যা কমতে কমতে এবার সারা দেশে ২শ’ ৮৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মাত্র ১১টি আসনে জয় লাভ করে দলটি।

রংপুরের ছয়টি আসনের মধ্যে সদর (রংপুর-৩) আসনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সব নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয় লাভ করেন। শুধু একবার অস্ত্র মামলায় সাজা হওয়ায় তার পরিবর্তে জি এম কাদের জয় লাভ করেন। বাকি পাঁচটি আসনের মধ্যে রংপুর-১, ২, ৪ ও ৫ জাতীয় পার্টির দখলে ছিল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে হাতছাড়া হয়ে যায় রংপুর ২, ৪ ও ৫ আসন। ওই আসন গুলোতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয় লাভ করে। শেষ পর্যন্ত রংপুর-১ ও সদর আসনটি জাতীয় পার্টির দখলে থাকে।

তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে রংপুরে যারা জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন, তারা পুরো জেলায় দলের সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করায় দলের উপজেলা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে চরম স্থবিরতা তৈরি হয়। যার ফলে রংপুর সদর আসন ছাড়া বাকি পাঁচটি আসনের সাত উপজেলায় জাতীয় পার্টির কার্যক্রম ছিলই না বললে চলে। এসব কারণে এবার বিগত ছয়টি সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির দখলে থাকা রংপুর-১ আসনটি এবারের নির্বাচনে হাতছাড়া হয়ে যায়। রংপুর-১ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী, দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ায় শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। তার জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়। রংপুর সদর আসনে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের জয়ী হন।

অপরদিকে, রংপুরের বাকি চার আসনের মধ্যে শুধু রংপুর-৪ আসনের প্রার্থী মোস্তফা সেলিম বেঙ্গল ছাড়া রংপুর-২, ৫ ও ৬ আসনের জাপা প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। তারা সবাই পরাজিত হন শোচনীয়ভাবে।

তৃণমূল পর্যায়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানান, রংপুর জাপার দুর্গ ছিল, এটি যেমন সঠিক, তেমনি সেই দুর্গ এখন অতীত ইতিহাস হয়ে গেছে। গত ১৫ বছরে জাপার শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা কেউই এসব এলাকায় আসেননি। তার পরেও এরশাদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে সহানুভূতি ছিল, তিনি মারা যাওয়ার পর দলের শীর্ষ নেতারা এরশাদের সেই ইমেজকে কাজে লাগাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও রংপুর-৩ (সদর) আসনের নবনির্বাচিত এমপি জি এম কাদের জাতীয় পার্টির দুর্গ এখনও আছে বলে দাবি করে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ যেসব আশ্বাস দিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশ নিতে বলেছিল, তার কোনোটাই বাস্তবায়ন করেনি। সোমবার রংপুর নগরীর স্কাই ভিউ বাসভবনে তিনি বলেন, ‘২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছিল ঠিক। কিন্তু শুধু আমার আসন ছাড়া বাকি ২৫টি আসনেই তাদের দলের প্রভাবশালী নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আমাদের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছে। ওই প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়নি তারা। শুধু তাই নয়, ছাড় দেওয়ার নামে প্রহসন করেছে সরকার। আমরা এমন ছাড় চাইনি, কিন্তু তারা প্রহসন করেছে। নির্বাচনের আগে থেকে আমাদের প্রার্থীদের ওপর হামলা, নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র দখল জোর করে ব্যালটে সিল মেরে নিয়ে তাদের প্রার্থীদের জয়ী করা হয়েছে। এর পরিণাম আওয়ামী লীগ বুঝতে পারবে। কারণ ভবিষ্যতে তাদের কেউ আর বিশ্বাস করবে না।‘

তিনি দাবি করেন, রংপুর অঞ্চলের ২২টি আসনে এখনও জাতীয় পার্টির জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন আছে এবং থাকবে।