যেসব কারণে হেরেছেন বাদশা

রাজশাহী-২ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য ছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। ১৪ দলের প্রার্থী হয়ে তার হাত ধরে ২০০৮ সালে নৌকা এই আসনটি ফিরে পেয়েছিল। ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী মিজানুর রহমান মিনুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১২ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে তার ভরাডুবি হয়েছে। তিনি ২৪ হাজার ভোটে হেরেছেন।

এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশার কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন বামপন্থি এই রাজনীতিবিদ। নৌকার টিকেটে ২০০৮ সাল থেকে টানা তিনবার এমপি নির্বাচিত হন ফজলে হোসেন বাদশা। কিন্তু জনবিচ্ছিন্নতা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, নিজ দলের নেতাকর্মী সংকট, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি-লোপাটের অভিযোগ এবং তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার মতো দলীয় এজেন্ডা না থাকায় হেরেছেন তিনি। 

ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই নির্বাচনে নিজের কেন্দ্রেও জিততে পারেননি ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক। সব কেন্দ্র মিলিয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির বাদশা পেয়েছেন ৩১ হাজার ৪৬০ ভোট। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশা কাঁচি প্রতীকে পেয়েছেন ৫৫ হাজার ১৫৬ ভোট। ব্যবধান প্রায় ২৪ হাজার। ফজলে হোসেনের নিজ কেন্দ্র জুলফিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ভোটার দুই হাজার ১৬০ জন। ভোট পড়েছে মাত্র ৫৩৫টি। বাতিল হয়েছে ১২টি। স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশা পেয়েছেন ৩৪০টি। ফজলে হোসেন বাদশা পেয়েছেন মাত্র ১৭৩টি। যদিও রাজশাহীর প্রধান এই আসনটিতে ভোট পড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ।

জানা গেছে, জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের মধ্যে বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত সদর আসনটি সিটি করপোরেশন এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের কারণে এখানে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে বেশ শক্তিশালী।

রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভোটাররা বলেছেন, রাজশাহীতে ওয়ার্কার্স পার্টির কোনও ভোটব্যাংক নেই। কেবলমাত্র দলের বড় একটি পদে থাকায় জোটের বিশেষ বিবেচনায় আওয়ামী লীগের ভোটে ১৫ বছর ধরে এই গুরুত্বপূর্ণ আসনের এমপি ছিলেন ফজলে হোসেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈরিতায় জড়িয়েছেন বারবার। সিটি মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন। এবার নৌকা প্রতীক পেয়েও রাজশাহী আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় মুখ লিটনের সঙ্গে দেখা করতে যাননি বাদশা। এসব কারণে বাদশার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়। তাই ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকে নৌকা থেকে নামাতে ভোটের আগে মহানগর আওয়ামী লীগ আনুষ্ঠানিকভাবেই মাঠে সোচ্চার হয়। দলের নেতাকর্মীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশাকে জেতাতে মরিয়া ছিলেন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, ওয়ার্কার্স পার্টির যুব ও ছাত্র সংগঠনগুলো এখন সারাদেশে বিলুপ্তপ্রায়। একসময় বাম আদর্শের চর্চা হওয়ায় তরুণ প্রজন্ম বেশ উজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্তু এখন সেই চর্চা নেই। তরুণদের স্বপ্ন জাগানোর মতো কার্যক্রমও নেই। ফলে নামমাত্র রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে ওয়ার্কার্স পার্টি। সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায়নি। ধীরে ধীরে নিজস্ব নেতাকর্মীও হারিয়েছে দলটি। তিনবার এমপি হলেও জনবিচ্ছিন্ন ছিলেন বাদশা। মানুষের সঙ্গে মিশতেন না। পারিবারিকভাবে ও ঘরোয়া পরিবেশে দলীয় নেতাকর্মী নিয়েই ছিলেন। এ কারণে নিজের পায়ে ভর করে ভোটে সফল হতে পারেননি।

তারা আরও বলছেন, এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রথমে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলী কামালকে। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ঘোষণার পর তাকে নিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা আনন্দ মিছিল করেছিলেন। ১৪ দলের মনোনয়ন ঘোষণার পরে মোহাম্মদ আলীকে বাদ দিয়ে সেই নৌকা ফজলে হোসেন বাদশাকে দেওয়া হয়। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নির্বাচনি প্রচারণা শুরুর পর ফজলে হোসেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ডাকেননি, এমনকি তাদের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করেননি। এ অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিয়ে দেন তারা। ফলে নৌকা পেলেও অস্বস্তিতে ছিলেন ফজলে হোসেন।

এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল বলেছেন, ‘আমরা নৌকার পক্ষে, দলের কেউ নৌকার বিপক্ষে নই। সব সময় নৌকার জন্য কাজ করেছি। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন নৌকার জন্য কাজ করছেন। কিন্তু ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীক পেয়ে আমাদের নেতা খায়রুজ্জামান লিটনকেই যদি সভা-সমাবেশে না ডাকেন, তাহলে কী আমাদের ঠেকা পড়েছে যে, তার বাসায় গিয়ে নৌকার জন্য কাজ করতে হবে। আমাদের দলের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করায় এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে জেতানোর জন্য মাঠে নেমেছিলাম আমরা।’

নৌকার প্রার্থীর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘আমাকে যেখানেই ডাকা হয়, সেখানেই যাই। কিন্তু নৌকার প্রার্থী আমাকে নির্বাচন করার জন্য আমন্ত্রণ জানাননি। এখন আমরা যদি দলীয় নেতাকর্মীদের মতামত নিয়ে দলের সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশাকে সমর্থন দিই, তাহলে অপরাধ হবে না। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ হবে না। এজন্য যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জবাব দিতে হয়, তাহলে সেই জবাব আমি দেবো। সেই জবাব দেবেন খায়রুজ্জামান লিটন। আমরা যখন মাঠে নেমেছি, তখন শফিকুর রহমানকে বিজয়ী করে ফিরেছি। আমরা নৌকার বিপক্ষে নই, ফজলে হোসেন বাদশার বিপক্ষে ছিলাম।’

তবে ভোটে পরাজয়ের কারণ জানতে চাইলে এই মুহূর্তে ফজলে হোসেন বাদশা প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। এ বিষয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন।

মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক দেবাশিষ প্রামাণিক দেবু বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলের জোট ছিল কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে। জোটবদ্ধভাবেই আমরা অতীত থেকে নির্বাচন করে আসছি। কিন্তু এবার মহানগর আওয়ামী লীগের একটি অংশ ষড়যন্ত্র করে ১৪ দলের জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত করলো। এটি দুঃখজনক।’

এদিকে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ তুলেছেন নৌকার প্রার্থী ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি দাবি করেছেন, স্বতন্ত্র কাঁচি প্রতীকের প্রার্থীকে জেতাতে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ এনে মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেন বাদশার আইনজীবী। অভিযোগে সিটি করপোরেশন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে সাত দফা অভিযোগ আনা হয়েছে।

এতে সাতটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে ধরে ১৪ দলের পরাজিত এই নেতা নির্বাচন কমিশনের কাছে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগে বলা হয়, নির্বাচনের প্রচারণার শুরু থেকে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এই আসনে কাঁচি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে ভোট প্রার্থনা করা হয়। প্রচারণার শুরু থেকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন তার কর্মচারীদের সুনির্দিষ্টভাবে কাঁচি প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনি তৎপরতায় যুক্ত করে। এমনকি সিটি করপোরেশনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির নির্দেশে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যতীত ওয়ার্ড কাউন্সিলররা নিজ নিজ ওয়ার্ডে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁচি প্রতীকে ভোট না দিলে সরকারি বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেন। নির্বাচনের দিন উল্লেখিত ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজস্ব বাহিনী প্রতিটি ওয়ার্ডের কেন্দ্রে গিয়ে নৌকা প্রতীকের ভোটারদের চিহ্নিত করে কেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করে। এই ক্রমাগত হুমকি ও ভয়ভীতির কারণে ভোটের দিন ভোটাররা নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে আসতে পারেননি। যার প্রভাব পড়েছে ভোটে। নির্বাচনি প্রক্রিয়ার শুরু থেকে সিটি করপোরেশনের আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্প সিডিসির কর্মীদের কাঁচি প্রতীকের পক্ষে ব্যবহার করা হয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরও সিটি করপোরেশনের মেয়র উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন অব্যাহত রাখেন। সেই সঙ্গে তিনি সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রজ্ঞাপন জারি হওয়া ব্যতিরেকেই নিজের পদবীর সঙ্গে ‘প্রতিমন্ত্রী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং তা দিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন। ভোটের দিন আচরণবিধি লঙ্ঘন করে কাঁচি প্রতীকে ভোটদানের শর্তে তাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রিকশা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তারা চিহ্নিত ভোটারদের বাসা থেকে ভোটকেন্দ্রে এনে ভোট নিশ্চিত করেছেন। এই রিকশার পুরো ব্যয়ভার বহন করা হয়েছে কাঁচি প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষ থেকে, যা আচরণবিধির পরিপন্থি।