একটি সেতুর জন্য তাদের অর্ধ শতাব্দী অপেক্ষা

স্বাধীনতার পর থেকে রুমা খালের ওপর একটি সেতুর স্বপ্ন নিয়ে দিন পার করছে মুনলাইপাড়ার মানুষ। কিন্তু তাদের এ স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেনি কেউ। সারা দেশে যখন বিভিন্ন উন্নয়নকাজ চলে, সেখানে একটি সেতু পাল্টে দিতে পারে সাতটি পাড়ার প্রায় কয়েক শ পরিবারের জীবন-জীবিকা।

জানা গেছে, বান্দরবানের রুমা উপজেলার সদর ইউনিয়নের নিকটবর্তী সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মুনলাইপাড়া। এখান থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে গেছে রুমা খাল। সেই খালের ওপারে রয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রায় সাতটি পাড়ার প্রায় কয়েক শ পরিবারের বসবাস। শুধু রুমা খালের ওপর একটি সেতুর অভাবে যুগের পর যুগ ধরে এসব পাড়ার বাসিন্দারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গন্তব্যে যায় হেঁটে।

স্থানীয়রা জানান, রুমা খাল থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা হেঁটে পৌঁছাতে হয় ম্রোদের হমক্রি পাড়ায়। বান্দরবান জেলার সবচেয়ে বেশি ড্রাগন ফলের বাগানও সেখানে। জেলার সিংহ ভাগ ড্রাগন ফলের জোগানও আসে সেখান থেকে। সেতুটি নির্মাণের ফলে পরিবহন সহজ হবে এবং আগের চেয়ে কম দামে এলাকার মানুষ ড্রাগন ফল কিনতে পারবে বলেন জানান চাষিরা।

তারা বলেন, একটি সেতু নির্মিত হলে এসব পাড়ার জুম চাষে উৎপাদিত নানা রকম সবজি ছাড়াও কলা, পেঁপে, আনারস, আমসহ বিভিন্ন উৎপাদিত ফল সহজে ও কম খরচে বাজারজাত করা যাবে। এতে বান্দরবানবাসীর চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও পাঠানো সহজ হবে।

হমক্রি পাড়ার কারবারী হমক্রি ম্রো বলেন, আমাদের পাড়ায় ৪৮ পরিবারের কয়েক শ মানুষের বসবাস। পাড়াটি রুমা সদরের কাছে হওয়া সত্ত্বেও রুমা সদর থেকে হেঁটে আসতে সময় লাগে পাঁচ ঘণ্টার মতো। অথচ জেলার সবচেয়ে বড় ড্রাগন বাগান এখানে। একটি মাত্র ব্রিজের অভাবে আমাদের এ পাড়ার মানুষ ছাড়াও আরও ছয়টি পাড়ার মানুষ এখানকার উৎপাদিত ফলফলাদি অনেক কষ্টে বহন করে নিয়ে যায়। আবার সময়মতো পরিবহন করতে না পারায় সিংহভাগই নষ্ট হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, যদি রুমা খালের ওপর সেতু করা যায়, তাহলে সহজে এসব পণ্য কম খরচে ও কম সময়ের মধ্যে বাজারজাত করতে পারতাম।

ক্যমবুয়া পাড়ার বাসিন্দা মংসাথোয়াই মারমা বলেন, সদর ইউনিয়ন থেকে অল্প দূরত্বের হলেও একটি ব্রিজ না থাকায় আমাদের হেঁটে চলতে হচ্ছে বছরের পর বছর। যার কারণে এলাকার সব কাজে ব্যয় হচ্ছে দ্বিগুণ। এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও রয়েছে। যান চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় বিদ্যালয়েও লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। এ সময় তিনি দ্রুত সেতু নির্মাণের দাবি জানান।

ক্যমবুয়া পাড়ার সাবোথোয়াই কারবারী জানান, এ পাড়ায় রয়েছে ৩৬টি পরিবার। সবাই জুম চাষের সবজি এবং পাহাড়ে বিভিন্ন ফল বিক্রির ওপর নির্ভর করে জীবিকা চালায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পাড়ার মানুষ রুমা খালের ওপর একটি ব্রিজের স্বপ্ন দেখে আসলেও তাদের এ স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেনি কেউ। একটি ব্রিজের অভাবে উন্নয়নের কোনও ছোঁয়া লাগেনি এ এলাকায়। তাই আমাদের সবার প্রাণের দাবি একটি মাত্র ব্রিজ।

এদিকে সম্প্রতি রুমা খালের ওপর সেতু নির্মাণের স্থানটি পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) আমফান প্রকল্প (ব্রিজ প্রকল্প) উপপরিচালক মো. এবাদত হোসেন ও বান্দরবান নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়াউল ইসলাম মজুমদারসহ জেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা।

আমফান প্রকল্প (ব্রিজ প্রকল্প) উপপরিচালক মো. এবাদত হোসেন বলেন, আমি বান্দরবানের সব কটি উপজেলা পরিদর্শন করেছি। এখানকার অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে শুধু একটি ব্রিজের জন্য সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থমকে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি শিগগির দুর্গম এলাকাগুলোয় সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করতে পারবো।

বান্দরবান এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়াউল ইসলাম মজুমদার বলেন, আমরা ব্রিজের পাশাপাশি দুর্গম এলাকায় পরিবহনের জন্য রাস্তা নির্মাণেরও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। পলিকা পাড়া থেকে রিজুক যাওয়ার পথে একটি সড়ক নির্মিত হলে ওই এলাকার মানুষের চলাচল ও পণ্য আনা সহজ হবে। অপরদিকে রিজুক ঝরনাতেও পর্যটকরা সহজে আসতে পারবে।

এ ছাড়া রাইক্ষ্যং লেকে যাওয়ার জন্যও একটি সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি নির্মিত হলে পাহাড়ের চূড়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লেকটি পর্যটকরা উপভোগ করতে পারবেন। রুমা ছাড়াও পুরো জেলাজুড়ে দুর্গম এলাকায় সব ধরনের ব্রিজ, কালভার্ট ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কথা জানান তিনি।