ওপরে ভিনদেশি ফল নিচে ফুলের বাগান, শখ থেকে স্বাবলম্বী

শখের বশে ভিনদেশি সফেদা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন যশোরের ফুল চাষি হজরত আলী বাবু। চারা লাগানোর তিন বছরের মাথায় ধরেছে সফেদা। ফুলের পাশাপাশি ফল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন তিনি।

হজরত আলী বাবু (৪২) যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার হাড়িয়া গ্রামের বেলেমাঠ এলাকার বাসিন্দা। কর্মজীবন শুরু নার্সারি দিয়ে। ১২ বছর পার হয়েছে নার্সারি পেশায়। আট বছর আগে প্রথমে রাস্তার পাশের জমিতে ফলের চাষ শুরু করেছিলেন। কিন্তু গাছের ফল পাকলে লোকজন পেড়ে নিয়ে যেতো। রাগ করে সব গাছ কেটে ফেলে সেখানে গাঁদা ফুলের চাষ করেন। ফুলের পাশাপাশি এখন ফল চাষি তিনি।

শুরুর কথা

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে মাসুদ আলম নামে এক ব্যক্তি হজরত আলীর নার্সারি থেকে বিভিন্ন গাছের চারা নিতেন। তার কাছে শুনতে পান সফেদা চাষের কথা। তার সফেদা গাছে প্রচুর ফলন হতো। বিষয়টি তাকে ভাবায়। বছর চারেক আগে সাতক্ষীরা থেকে থাইল্যান্ডের ৩৫টি সফেদার চারা আনেন। সে সময় তার ১২ কাঠা জমিতে গোলাপ চাষ হতো। এই ফুলের সঙ্গেই সফেদার চাষ শুরু করেন।

১২ কাঠা গোলাপ বাগানের ফাঁকা স্থানে ১০-১২ ফুট দূরত্বে সফেদার চারা লাগাই জানিয়ে হজরত আলী বলেন, ‘তিন বছর পর গাছে ফলন আসা শুরু করে। এই সফেদা যেমন মিষ্টি, তেমন সুস্বাদু। প্রথমে ফল আসে একটু কম। সেগুলো নিজেরা খাই, লোকজনকেও খাওয়াই। ধীরে ধীরে গাছ বড় হয়ে যায়।’

চাষ পদ্ধতি

হজরত আলীর ভাষ্য, ‘চারা কেনার আগে এবং পরে মাসুদ ভাইয়ের কাছ থেকে শুনে নিয়েছি, এগুলো ফাঁকা ফাঁকা স্থান রেখে লাগাতে হয়। ধীরে ধীরে গাছ বড় হয়ে যায়। প্রচুর রোদের প্রয়োজন হয়। আমার জমিটা বেলে-দোআঁশ মাটির। প্রথমে একটু গর্ত করে সেখানে গোবর সার, পটাশ ও জিঙ্ক মিশিয়ে চারা লাগিয়ে মাটি দিয়ে গোড়া ভরাট করে দিই। এরপর গোড়ায় যাতে পানি না জমে, সেভাবে একটু উঁচু করে দিই। চারা লাগানোর পর এক দফা সেচ দিতে হয়। ধীরে ধীরে গাছ বড় হলে সেচের পরিমাণ কমাতে হয়।’

ফলন

চারা লাগানোর তিন বছরের মাথায় প্রথম ফলন পাই উল্লেখ করে হজরত আলী বলেন, ‘প্রথমবার অল্প ফলন হয়েছিল। সেগুলো নিজেরা খেয়েছি, প্রতিবেশী ও স্বজনদেরও দিয়েছি। তিন মাস আগে দ্বিতীয় দফায় ফলন পেতে শুরু করি। এবার খাওয়ার পাশাপাশি বিক্রি করছি। এতে স্বাবলম্বী হয়েছি আমি।’

সফেদা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন যশোরের ফুল চাষি হজরত আলী বাবু

নাভারণ থেকে একজন ব্যবসায়ী এসে বাগান থেকে সফেদা কিনে নিয়ে যান জানিয়ে এই চাষি আরও বলেন, ‘প্রতি পিস চার-পাঁচ টাকায় বিক্রি করি। গত সপ্তাহে ৫০০ পিস বিক্রি করেছি। ১২-১৫ দিন পরপরই ওই ব্যবসায়ী এসে ফল নিয়ে যান। শুনেছি, তিনি প্রতি পিস দুই-তিন টাকা লাভে বিক্রি করেন। গত তিন মাসে সফেদা বিক্রি থেকে ১৭ হাজার টাকা পেয়েছি। পাশাপাশি ফল গাছের চারাও বিক্রি করছি। প্রতি পিস চারা একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকায় বিক্রি করি।’

সাথী ফসল

গত মৌসুমে এই সফেদা ক্ষেতে চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষ করেছি উল্লেখ করে হজরত আলী বলেন, ‘প্রায় ৩০ হাজার টাকার চন্দ্রমল্লিকা বিক্রি করেছি। এ বছর চন্দ্রমল্লিকার পাশাপাশি গাঁদা ফুল লাগিয়েছি। আশা করছি, এবারও ৩০ হাজার টাকার বেশি ফুল বিক্রি করতে পারবো। দুই মাসের মধ্যে ফুল বিক্রির উপযোগী হবে। ফুল বাগানের ওপরে সফেদা গাছ। এখনও ফলন ধরে আছে। একসঙ্গে ফুল-ফলের বাগান আসলেই সুন্দর।’

থাইল্যান্ডের সফেদা

থাইল্যান্ডের সফেদা উন্নতজাতের ফল। হজরত আলীর ক্ষেতে দুই ধরনের সফেদা রয়েছে। একটি পটল আকৃতির আরেকটি গোল আকৃতির। সারা বছর ফলন পাওয়া যায়, অর্থাৎ বারোমাসি ফল। দ্রুত ফলন আসে। তবে গাছ তেমন একটা বড় হয় না। কিন্তু ফলন বেশি হয়।

ফুলের পাশাপাশি ফল চাষ করে স্বাবলম্বী

হজরত আলীর দাবি

চার বছর আগে ঝিকরগাছায় প্রথম থাই সফেদা চাষ করেছি দাবি করে হজরত আলী বলেন, ‘সাতক্ষীরা অঞ্চলে এই ফলকে ক্রিকেট বল হিসেবে লোকে চেনে। আমি চাষ করার পর এখন পর্যন্ত কোনও কৃষি কর্মকর্তা মাঠে আসেননি। চাষ পদ্ধতি বা পরিচর্যা নিজের মতই করেছি। আট বছর আগে রাস্তার পাশের ৯ কাঠা জমিতে বরই, দেড় বিঘায় লিচু, ১৬ কাঠায় আম চাষ করেছিলাম। কিন্তু ফল এলে বেশিরভাগ চুরি হয়ে যেতো। সে কারণে রাগ করে গাছগুলো কেটে ফেলেছি। এখন বাড়ির পাশে সফেদা ও ফুল চাষ করছি।’

খুবই উপকারী ফল সফেদা

সফেদার চাষ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হাসান পলাশ বলেন, ‘সফেদা মূলত লবণাক্ত পানিতে বেশি জন্মায়। এটি এই অঞ্চলে ভালো ফল দেয়। এতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। যা অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুদের জন্য খুবই উপকারী। মস্তিষ্কের গঠনে এই ফলের জুড়ি নেই।’