একটি অদ্ভুত ছবি এবং মিক্সড অ্যালবাম সৃষ্টির ইতিহাস

শুধু অডিও ইন্ডাস্ট্রির উত্থান বললে ভুল হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৯৯০-২০০০ সাল এমনই একটি দশক, যে সময়ে গান নামের সোনা ফলেছে মুহুর্মুহু। রক, আধুনিক, ফোক, রিমেক, ফিউশনসহ প্রায় সব ধরনের গানের জন্ম হয়েছে এবং শ্রোতারা তার প্রায় সবটুকুই লুফে নিয়েছে। এরমধ্যে সবকিছু ছাপিয়ে অডিও ইন্ডাস্ট্রিকে আজও সমৃদ্ধ একটি ইতিহাস উপহার দিয়ে রেখেছে ব্যান্ড ও একক অ্যালবামের বাইরে গিয়ে একঝাঁক তারকা নিয়ে ‘মিক্সড অ্যালবাম’ কনসেপ্ট।

যার শুরুটা হয়েছে ১৯৯৩ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক-এর ব্যানার থেকে সংগীত পরিচালক আশিকউজ্জামান টুলুর হাত ধরে। ঠিক ধরেছেন, ইনি সেই টুলু যিনি আর্ক ব্যান্ড গড়েছেন, যার গাওয়া ‘এই দূর পরবাসে তারা গুনে আকাশে আকাশে’ গানটি গেয়ে শ্রোতামনে অমর হয়ে আছেন এখনও। বাস্তবতাও এই, গানটি তিনি দেশে বসে প্রবাসীর কথা ভেবে তৈরি করলেও বাস্তবে এখন তিনি দূর পরবাস কানাডাতেই থিতু হয়েছেন পরিবার সমেত।

তবে আজকের প্রসঙ্গ আশিকউজ্জামান টুলুর প্রবাস জীবন নয়, ব্যান্ড ইতিহাসও নয় কিংবা হেলে পড়া মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিকে তুলে ধরার প্রয়াসও নয়। বরং এই প্রতিবেদনটির সূত্রপাত হয়েছে সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া একটি অদ্ভুত স্থিরচিত্র ঘিরে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ৯০ দশকের বেশ ক’জন ব্যান্ড তারকা দাঁড়িয়ে আছেন একসঙ্গে। সবার মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন টাক মাথার টুলু, যার পরনের টিশার্ট কোমর থেকে বুক পর্যন্ত ওঠানো! ছবিতে থাকা অন্য তারকাদের পোশাক আর অভিব্যক্তিও খানিকটা এলোমেলো।

ছবিটি ফেসবুকে লিক হওয়ার পর থেকেই ভাইরাল।

অবশেষে অদ্ভুত সেই ভাইরাল ছবিটি প্রসঙ্গে বিস্তর জানা যায় আশিকউজ্জামান টুলুর কাছেই। তিনি জানান, এই ছবিটি মজা করে একটি ফটো স্টুডিওতে তুলেছিলেন ৯৩ সালের দিকে। যা তারা প্রকাশ করেননি কোথাও। তবুও সেটি এখন প্রকাশ হলো এবং রীতিমতো ভাইরাল। ছবিটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নানা কৌতূহল। মূলত সেটি ভাঙালেন টুলু। বললেন, ‘এই কিম্ভূতকিমাকার ছবিটা সবার একধরনের দুষ্টামির বহিঃপ্রকাশ। অ্যালিফেন্ট রোডের মাথায় সাইন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে দোতলায় একটা স্টুডিও ছিল, সেখানে আলতাফ ভাই ছিলেন ফটোগ্রাফার, ওখানেই ছবিটা তুলেছিলাম। আসলে সেদিন আমরা সবাই একটা করে একক ছবি তুলেছিলাম, অ্যালবাম স্লিপে দেওয়ার জন্য। যার যার ছবি তোলার পর কেন যেন মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি চাপলো, একটা আজগুবি ছবি তোলার জন্য। সেকারণেই সবাই মিলে তুলেছিলাম এই ছবিটা। এটা শুধুই মজা করার জন্য তুলেছিলাম আমরা। ছবিটা কোথাও প্রকাশের জন্য তোলা হয়নি, প্রকাশও করিনি। কিন্তু কিভাবে যে চলে এলো ফেসবুকে, আমার জানা নাই।’

কিন্তু সেই সময়ের জনপ্রিয় ১০ জন ব্যান্ড তারকা একহয়ে এমন একটি ফটোশুট করতে গেলেন কেন? এবার টুলুর আলাপে উঠে আসে ব্যান্ড মিক্সড অ্যালবামের নতুন ইতিহাস রচনার গল্প। সেই গল্পে যাওয়ার আগে যেনে নেওয়া যাক, অদ্ভুত এই স্থিরচিত্রে টুলুর (আর্ক) সঙ্গে কারা আছেন। তারা হলেন, মাকসুদ (ফিডব্যাক), নকীব খান (রেনেসাঁ), বিপ্লব (প্রমিথিউস), চন্দন (উইনিং), রানা (ফেইম), টিপু (অবসকিউর), শামীম ও পঞ্চম (আর্ক)। এই শিল্পীদের সঙ্গে আজম খান, সামিনা চৌধুরী ও নিলয় দাশকে নিয়ে আশিকউজ্জামান টুলু তৈরি করেন বাংলাদেশের প্রথম ‘মিক্সড অ্যালবাম’। যার নাম ‘স্টারস’।       

সংগীতে এখনও নিয়মিত আশিকউজ্জামান টুলু অ্যালবামটি তৈরির গল্প জানালেন আশিকউজ্জামান টুলু। তিনি বললেন, ‘‘১৯৯৩ সালে একটা নতুন কনসেপ্ট-এর রূপায়ণ হিসাবে ‘স্টারস’ অ্যালবামটি তৈরি করেছিলাম। সেটি রিলিজ হওয়ার আগে, এই কনসেপ্টটা ছিল শুধুই ব্যক্তিগত স্বপ্ন এবং যা ওই সময়ে বাস্তবে রূপান্তরিত করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলোনা। কারণ, এতগুলো স্বনামধন্য শিল্পী নিয়ে একটা অ্যালবাম এবং সেখানে ১৪টি একেবারে নতুন মৌলিক গান তৈরি করার কথা কেউ তো ভাবতেই পারেনি। সত্যি বলতে আইডিয়াটা আমার মাথায় ঘুরপাক খেলেও, সেটি যে বাস্তবে সম্ভব আমি নিজেও ভাবতে পারিনি। তাছাড়া এতবড় বাজেটের অ্যালবামে অর্থ লগ্নি করার মতো প্রযোজকও ছিলো না তখন।’’

তবুও সেটি বাস্তবে ঘটিয়ে দেখালেন ‘আর্ক’ যোদ্ধা টুলু। এই যুদ্ধে তার সঙ্গে পেয়েছিলেন আজকের কিংবদন্তি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সাউন্ডটেক-এর কর্ণধার সুলতান মাহমুদ বাবুলকে। আর সেটি সম্ভব হয়েছে আরেক কিংবদন্তি ফিরোজ সাঁইয়ের কারণে। স্মৃতিকাতর টুলু বলেন, ‘তখন সাউন্ডটেকের কেবল জন্ম হয়েছিল। প্রয়াত গ্রেট পপ আর্টিস্ট ফিরোজ সাঁই আমাকে সাউন্ডটেকের কর্ণধারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। কারণ হচ্ছে, আমি ফিরোজ ভাইয়ের একটা অ্যালবামের মিউজিক ডিরেকশন করবো এবং সেটা সাউন্ডটেকের ব্যানারে বের হবে। বাবুল ভাই অ্যালবাম তথা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে অর্থ লগ্নি করার জন্য প্রথম ফিরোজ ভাইয়ের কাছে যান এবং ফিরোজ ভাই বাবুল সাহেবকে প্রথমে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর সাউন্ডটেক সর্বপ্রথম প্রজেক্ট হিসাবে ফিরোজ ভাইয়ের ঐ অ্যালবামটা প্রোডিউস করে। অর্থাৎ ওটাই ছিল সাউন্ডটেকের প্রথম অ্যালবাম, যার মিউজিক আমার করা।’

সেই সূত্রে নতুন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের অভিষেক হলো ফিরোজ সাঁইয়ের একক অ্যালবাম দিয়ে। যার সংগীত পরিচালনা করেছেন আশিকউজ্জামান টুলু। ফলে প্রযোজক সুলতান মাহমুদ বাবুলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক বা আস্থা তৈরি হয় টুলুর। সেই সুবাদে তার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া মিক্সড অ্যালবামের আইডিয়াটি শেয়ার করেন সুলতান মাহমুদ বাবুলের সঙ্গে। প্রযোজকের হাতে লগ্নি করার জন্য তখন বেশ টাকা ছিলো। টুলুর আইডিয়াটি লুফে নেন প্রযোজক। শুরু হয়ে যায় অ্যালামটির কাজ।
    
মিক্স অ্যালবাম জনকের সঙ্গে সবচেয়ে সফল মিক্স অ্যালবাম প্রণেতা প্রিন্স মাহমুদ টুলুর ভাষায়, ‘‘স্টারস’ অ্যালবামটা রিলিজ হয়ে যাওয়ার পরে বাংলাদেশে শুরু হয়ে যায় মিক্সড অ্যালবামের জোয়ার। পরবর্তীতে বহু মিক্সড অ্যালবামের সৃষ্টি হয় এবং সাথে অনেক তরুণ মিউজিক ডিরেক্টর ও গীতিকার এবং অ্যালবাম উদ্যোক্তার পদার্পণ ঘটে আমাদের দেশের সংগীতাঙ্গনে। এর আগে একজন নতুন মিউজিক ডিরেক্টরের জন্য নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর বিষয়টা খুব কঠিন ছিল। কারণ গান করতে গেলে কোনও অ্যালবামে হয় একটা কিংবা দুইটা গান করার সুযোগ পেতো। এবং সেটাও একজন নির্ধারিত শিল্পীর অ্যালবামে। এরমধ্যে নতুনরা তো আর বড় শিল্পীর অ্যালবামে সুযোগই পেতো না সচরাচর। ফলে সুরকারদের প্রতিভার বিকাশ করার সুযোগটা ছিলো সীমিত। কিন্তু এই মিক্সড অ্যালবাম কালচার শুরু হওয়াতে একজন নতুন মিউজিক ডিরেক্টরকে একাধিক তারকা শিল্পীর গান করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। যার ফলে তখন অনেক নতুন প্রতিভার বিকাশের পথ সুগম করে দিয়েছিলো। আবার সেই অ্যালবামগুলোও শ্রোতারা লুফে নিতো। কারণ একসঙ্গে অনেক তারকার গান পাওয়া যেতো। প্রযোজকরা তাই এই মিক্সড অ্যালবাম করে আরাম পেতো। সবমিলিয়ে তখন মিক্সড অ্যালবাম মানেই সুপারহিট। যার ফলে সবাই খুশি থাকতো।’’ 

টুলু জানান, এই মিক্সড অ্যালবাম কালচারের কারণে তখনকার তারকা শিল্পীরাও বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতো। তার ভাষায়, ‘তখন কণ্ঠশিল্পীদের বছরে একটা কিংবা দুই বছরে একটা একক অ্যালবামে গান প্রচারের ওপর নির্ভর করতে হতো। এরমধ্যে মিক্সড অ্যালবাম চালু হওয়াতে তাদের গান করার সুযোগটা বেড়ে গেলো। দেখা গেলো, নিজের একক অ্যালবামের পাশাপাশি বছরে আরও গোটা পাঁচেক মিক্সড অ্যালবামে গাইতে পারছেন তারা। যেখান থেকে প্রচুর অর্থ উপার্জনও করা যেতো। কারণ মিক্সড অ্যালবামের ৫টা গানের পেমেন্ট অনেক সময় একটা একক অ্যালবামের ১২টা গানের পেমেন্টের চাইতেও বেশী ছিল।’

বলা ভালো, আশিকউজ্জামান টুলুর কনসেপ্ট ও সুর-সংগীতে তৈরি দেশের প্রথম মিক্সড অ্যালবাম ‘স্টার্স’ সুপারহিট হয়। যার প্রতিটি গানই হয় জনপ্রিয়। সেই ধারাবাহিকতায় আইয়ুব বাচ্চু, জুয়েল-বাবু, প্রণব ঘোষ, প্রিন্স মাহমুদ, শওকাতসহ অনেক সংগীত পরিচালক ও আয়োজকের আবির্ভাব ঘটে মিশ্র অ্যালবামে।

‘স্টারস’ সিরিজের দ্বিতীয় অ্যালবাম:

বলা দরকার, দেশের প্রথম মৌলিক মিক্সড অ্যালবাম ‘স্টারস’ প্রকাশের আগে ৯১ সালের দিকে আশিকউজ্জামান টুলু প্রকাশ করেন একই কনসেপ্টে ‘কপিয়ার’ ১ ও ২ নামে একাধিক শিল্পীকে নিয়ে অ্যালবাম। তবে সেটিকে প্রথম মিক্সড অ্যালবাম হিসেবে স্রষ্টা নিজেই স্বীকৃতি দিচ্ছেন না, কারণ ওই অ্যালবাম দুটির সবগুলো গানই ছিলো বিদেশি গানের সুর হুবহু নকল।