রেলওয়ের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় বাঁচলো ১২৫ শিক্ষার্থীর স্বপ্ন

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তাদের আপ্রাণ চেষ্টায় শতাধিক পরীক্ষার্থী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছেন। এই চেষ্টা করতে গিয়ে দুটি ট্রেনের যাত্রা বিলম্ব করতে হয়েছে। একটি ট্রেনকে থামিয়ে তার ইঞ্জিন কেটে নিয়ে রাজশাহীগামী ট্রেনে যুক্ত করতে হয়েছে। নির্ধারিত স্টেশনে যাত্রাবিরতি বাতিল করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্ধারিত স্টেশনে যাত্রাবিরতি করানো হয়েছে। তাদের এই প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গলবার (০৫ মার্চ) ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী ধূমকেতু এক্সপ্রেসে এ ঘটনা ঘটে। এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা যাায়, ধূমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে নিয়মতি ভোর ৬টায় ঢাকা থেকে ছাড়ে, পৌঁছে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে। কিন্তু এদিন ট্রেনটি অনেক দেরিতে চলছিল। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার ও পাকশী বিভাগের ব্যবস্থাপক শাহ সুফী নূর মোহাম্মদের বিশেষ উদ্যোগে মঙ্গলবার ধূমকেতু এক্সপ্রেসে থাকা শিক্ষার্থীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পেরেছেন। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ট্রেনের পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন অসীম কুমার তালুকদার।

ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ধূমকেতু এক্সপ্রেস ট্রেনে সি ইউনিটের পরীক্ষায় অংশ নিতে আসা শিক্ষার্থী ছিল ১২৫ জন। যারা ওই দিন বিকাল সাড়ে ৩টার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবেন। রেল ব্রোকেনের জন্য ধূমকেতু এক্সপ্রেস ঢাকা থেকেই বিলম্বে রওনা হয়। সকাল ১১টায় হিসাব করে দেখা গেলো, ট্রেনটি বিকাল ৩টা নাগাদ রাজশাহী পৌঁছাবে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া পার হয়ে। ভাগ্য এতই খারাপ, লাহেড়ী মোহনপুর স্টেশনে এসে ধূমকেতুর ইঞ্জিন ফেইল করে, চাকা ঘুরছে না। সে সময় নীলফামারী থেকে ঢাকাগামী চিলাহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনটি শরৎনগর স্টেশনে ছিল। সেই ট্রেনের ইঞ্জিন কেটে ধূমকেতু এক্সপ্রেসে যুক্ত করে ছাড়া হয় ট্রেন। কিন্তু এতে নষ্ট হয়ে যায় অনেকখানি সময়।

তখন হিসাব করে দেখা গেলো ট্রেনটি পৌঁছাবে বিকাল ৪টায়। ততক্ষণে পরীক্ষার আধা ঘণ্টা পেরিয়ে যাবে।

এ অবস্থায় অসীম কুমার তালুকদার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরীক্ষার সময় পেছানোর অনুরোধ করেন।

তিনি ফেসবুক পোস্টে আরও লিখেছেন, ভিসি মহোদয়কে পরীক্ষার সময় পেছানোর বিনীত অনুরোধ করলাম। তিনি আমাকে প্রায় চার বার ফোন করে ট্রেনের খবর নিলেন। ট্রেন সর্বোচ্চ অনুমোদিত গতিতে চলছে। তবু দুশ্চিন্তা ছাড়ছে না। পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উপায় না দেখে আড়ানী স্টেশনের স্টপেজে ট্রেন না থামিয়ে থ্রু পাস করলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে দিলাম, তখন বিকাল ৩টা ৩৮ মিনিট।

এতে স্বস্তি প্রকাশ করে অসীম কুমার তালুকদার আরও লিখেছেন, ভিসি মহোদয়কে বিনীত অনুরোধ করলাম ছেলেমেয়েদের হলে ঢোকার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তিনি কথা রাখলেন এবং রেলওয়ের সবাইকে ধন্যবাদ দিলেন। ট্রেন পরিচালনায় পাকশী কন্ট্রোলে সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করেন ডিআরএম (পাকশী)। এখন নিজেকে বেশ হালকা লাগছে।

ধূমকেতুর দেরি যেসব কারণে

রেলের পাকশী বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ জানান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে ঢাকা-রাজশাহী রুটের চারটি ট্রেনেরই সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়। প্রতিটি ট্রেনে যুক্ত করা হয় বাড়তি কোচ। এ কারণে এই রুটে ট্রেনের সময়সূচিতে গড়বড় লেগে যায়। ট্রেনে গোটা সপ্তাহে যে লেট হয়, সেটি সাপ্তাহিক ছুটিতে সমন্বয় করা হয়। কিন্তু এখানে সে সুযোগ ছিল না। আবার অতিরিক্ত কোচ যুক্ত হলে সেখানেও কিছু বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হয়। ট্রেনে পানি দেওয়া থেকে শুরু করে নানা কাজ করতে হয়। সেটিও করা যায়নি। আবার রেল লাইন ভেঙে গিয়েছিল। ট্রেনের লোকোমেটিভ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে এই ঘটনাটি ঘটে।

যেভাবে বাঁচানো হয় সময়

উল্লাপাড়া থেকে রাজশাহী যেতে ট্রেনে ২ ঘন্টা সময় লাগে। সেখানে ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিটে পৌঁছে ধূমকেতু। এ বিষয়ে নূর মোহাম্মদ বলেন, আমাদের উল্লাপাড়া থেকে রাজশাহী যেতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে। সেটা এক ঘণ্টা ৩৮ মিনিটে পৌঁছে দিয়েছি। চালককে বলেছি জোরে চালাবে। রেলে একটা অনুমোদিত সর্বোচ্চ গতি থাকে। আমরা কন্ট্রোল রুমে বসে সেটি ট্র্যাকিং করতে পারি। যখনই দেখেছি সেই গতির চেয়ে কমে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে তাগাদা দিয়েছি। আবার লাইন ক্লিয়ার করতে হয়। সেটি সাধারণত হাতে হাতে করা হয়। কিন্তু এতে সময় নষ্ট হতো। তাই সেটি না করে মোবাইল ফোন দিয়ে করেছি। এভাবেই ২৮ মিনিট বাঁচাতে পেরেছি।

এমন পদক্ষেপ নেওয়ার পেছনে দুটো কারণের কথা বলেন রেলের পাকশী বিভাগের মহাব্যবস্থাপক নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, আমাদের তাড়না ও ভীতি দুটোই কাজ করেছে। তাড়না বলতে এটা আবেগের বিষয়। আশা নিয়ে কত ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। রাজশাহীতে এই সময়ে প্রতি বছরই অনেক ছেলেমেয়ে আসে। সেখানে থাকার জায়গা পাওয়াও কঠিন। এ কারণে অনেকে আগের রাতে বা অন্তিম মুহূর্তে আসে। যদি পরীক্ষা দিতে না পারে, তাহলে তো তরুণরা আশাহত হবে। এটা মেনে নেওয়া কঠিন। এছাড়া ভীতি হলো শিক্ষার্থীরা যদি বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়! অনেক সময় তাদেরকে উসকানি দেওয়া হয়। তখন বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারতো।

এ ঘটনার বিষয়ে জানাতে বিকালে সংবাদ সম্মেলনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ধূমকেতু এক্সপ্রেসে থাকা ১২৫ পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছি। তাদের প্রায় ২০ মিনিট দেরি হয়েছিল। তবে তাদেরকে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়নি। নিয়মানুযায়ী পরীক্ষা শুরুর ১৫ মিনিট পরে কেন্দ্রে কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে মানবিক দিক বিবেচনায় তাদের পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।