সখীপুরের শাল-গজারি বনে এক মাসে ২৫ স্থানে আগুন!

শাল-গজারির বনে ঘেরা অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি টাঙ্গাইলের সখীপুরের বনাঞ্চলে এক মাসে অন্তত ২৫/৩০ টি জায়গায় আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সর্বশেষ শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) সরেজমিনে গজারিয়া বিটে সখীপুর-সিডস্টোর সড়কের কীর্ত্তনখোলা এলাকায় দেখা যায়, সেখানে একটি বনে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। 
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, গত এক সপ্তাহে অন্তত চারটি শাল-গজারির বনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

এর আগে গত বুধবার বিকেলে উপজেলার বহেড়াতৈল বিটের আওতায় ছাতিয়াচালা সাইনবোর্ড এলাকায় একটি গজারির বনে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে প্রায় পাঁচ একর গজারির বন আগুনে পুড়ে যায়। এছাড়া কৈয়ামধু বিটের বেতুয়াতেও গজারি বনে কয়েক দফায় আগুন লাগানো হয়েছে।

বনবিভাগের অনুমতি ছাড়া যেখানে প্রবেশ নিষেধ, সেখানে ঘটছে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা। প্রতিবছর এ মৌসুমে বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট ছোট গজারি গাছ, ঝোপঝাড়, পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ। বিনষ্ট হয় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বন পোড়ানোর কারণে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। বাসা হারাচ্ছে পাখিরা। ফলে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য নিদারুণভাবে নষ্ট হচ্ছে।

গত এক মাসে সখীপুরের বনাঞ্চলের ২৫টি জায়গায় আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যেও সর্বশেষ গত সপ্তাহে উপজেলার বহেড়াতৈল বিটের আওতায় ছাতিয়াচালা সাইনবোর্ড এলাকায় একটি গজারি বনে আগুন দেয়। এতে প্রায় পাঁচ একর গজারির বন আগুনে পুড়ে গেছে।

ডিবি গজারিয়া বিট কার্যালয়ের আওতাধীন অন্তত চারটি স্থানে শাল-গজারির বনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কালিয়ানপাড়া, গজারিয়া, কীর্ত্তনখোলা, বংকী এলাকায় শাল-গজারির এসব বনে আগুন দেওয়া হয়। এতে প্রায় ৮ থেকে ১০ একর বন পুড়ে যায়।

নলুয়া বিটের আওতাধীন দেওদীঘি বাজারের পশ্চিম পাশে দুটি গজারির বন, নলুয়া বিট কার্যালয়ের দক্ষিণ দিকে ৩০০ গজ দূরে একটি, ঘেচুয়া এলাকায় দুটি ও আমের চারা এলাকায় একটি বন আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

স্থানীয় বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সখীপুরে ৪টি রেঞ্জের আওতায় ১৩টি বিট কার্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার একর জমিতে শাল-গজারির বন রয়েছে। বসন্তকালে শাল-গজারির পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের আশপাশের বাসিন্দারা জমি দখল ও লকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রাতের আঁধারে বা কখনো দিনের বেলাতেও বনে আগুন দেন। ঝরা পাতাগুলো শুকনা থাকার কারণে মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

তুহিন আহমেদ নামের স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, বনের কাছাকাছি নিম্নআয়ের মানুষের বসবাস বেশি। তারা লকড়ি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনেক সময় গজারি বনে আগুন দিয়ে থাকেন। আবার কেউ বনের জমি দখলের উদ্দেশ্যে বন পোড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকেন। বনের ভেতরের সড়ক দিয়ে চলাচলকারীরাও অনেক সময় বনে আগুন দেন। মূলত জমি দখল আর লকড়ি সংগ্রহ করতেই আগুন দিয়ে থাকে দুর্বৃত্তরা।

স্থানীয় বাসিন্দা জুলহাস আহমেদ বলেন, গজারির বনে মাদক সেবীদের আনাগোনা থাকে, মাদক সেবনের পর তারা অনেক সময় গজারির মি পাতায় আগুন ধরিয়ে দেয়। এছাড়া কিছু অসচেতন বাসিন্দারাও পাতা পুড়ে সার হবে বলে আগুন ধরিয়ে দেয়।

এলাকাবাসীরা জানায়, আগুনে বড় গাছগুলো অর্ধমৃত আর নিচের ছোট ছোট হাজারো প্রজাতির গাছ পুড়ে গেছে। গজারি বনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলার এই চিত্র প্রায়ই দেখা যায়।

এ প্রসঙ্গে নলুয়া বিট কর্মকর্তা সাফেরুজ্জামান বলেন, দুই সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি গজারির বনে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। আমরা খুবই সতর্ক অবস্থায় আছি। জনবল কম থাকায় দেখভাল করতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা টাঙ্গাই‌ল শাখার সভাপতি ও মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ বলেন, এক শ্রেণীর অসাধু লোকজন অযথা শাল-গজারি বনে আগুন দিয়ে বন ধ্বংস করছে। এর ফলে পশু-পাখি বিলুপ্ত হতে চলছে। হুমকির মুখে পড়েছে এ অঞ্চলটির বন্যপ্রাণী।

পরিবেশবিদরা বলছেন, বনের মধ্যে আগুন দেওয়ার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বনের সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য আগুন দিয়ে লকড়ি তৈরির চিরায়িত অভ্যাস বাদ দিতে হবে।

উপজেলা বনায়ন কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ হোসেন পাটওয়ারী বলেন, এ জন্য বন বিভাগের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে সচেতনতামূলক সভা করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, সখীপুর উপজেলায় বন বিভাগের জনবল কম। তবে স্বল্প জনবল দিয়েই গণসচেতনতা বাড়ানোর কাজ করা হচ্ছে, যাতে লোকজন শাল-গজারি বনে আগুন না দেয়।



সালাউদ্দিন/সাএ