যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল

সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট  (এসএসসি) পরীক্ষার ফলে রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনও পরীক্ষার্থী পাস করেনি। ফলে প্রতিষ্ঠান দুটি শূন্য ফল প্রাপ্তির তালিকায় উঠেছে। গত আট বছরে এমন শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শিক্ষাবোর্ডে রয়েছে আটটি। চারপাশে শতভাগ পাসের মধ্যে শতভাগ ফেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে শিক্ষাবোর্ডকেও।

এমন প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রকাশ্যে না আসলেও ফল বিপর্যয়ের পেছনে নির্দিষ্ট বিষয়ে ফেল, শিক্ষক না থাকা, নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, বাল্যবিয়েকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডে গত আট বছরের এসএসসির ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোনও বছরে একটি ও কোনও বছর দুটি প্রতিষ্ঠান শূন্য ফল প্রাপ্তির তালিকায় এসেছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালে শতভাগ ফেল করা স্কুল ছিল একটি। ২০১৮-২০১৯ সালে একটি করে। ২০২০-২০২১ সালে শতভাগ ফেল করা স্কুল না থাকলেও ২০২২ সালে ছিল দুটি। ২০২৩ সালে একটি স্কুল থাকলেও সর্বশেষ ২০২৪ সালের এসএসসি ফলাফলে দেখা গেছে, শতভাগ ফেলের তালিকায় রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শতভাগ ফেল করা এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকের সংকট আছে। ফলে নিয়মিত ক্লাস নিয়ে এক ধরনের টানাপোড়েনে পড়তে হয়।। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে বছরের পর বছর নেই নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক। আবার শিক্ষার্থীও হাতেগোনা কয়েকজন।

এবার শতভাগ ফেল করা রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মোহনপুর উপজেলার ঢোরসা আদর্শ হাই স্কুলের পরীক্ষার্থী ছিল একজন ও নওগাঁর আত্রাই উপজেলার বরাইকুড়ি আইডিয়াল গার্লস হাই স্কুলের পরীক্ষার্থী ছিল পাঁচজন। আরেকটি হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের বজ্রনাথপুর দাখিল মাদ্রাসা। শিক্ষার্থী ছিল আট জন। সবাই ফেল করেছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি এমপিওভুক্ত নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষক আর শিক্ষার্থী সংকটের মধ্যে চলছে বরাইকুড়ি আইডিয়াল গার্লস হাই স্কুল। এ বছর পাঁচ পরীক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। গত বছর ছয় জন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একজন ফেল করেছিল। এ বছরের এমন ফলের পেছনে শিক্ষক না থাকাকে দায়ী করেন প্রধান শিক্ষক নবীর উদ্দিন। তিনি এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জে ফল পরিবর্তনের আশা প্রকাশ করেছেন।

২০০৪ সাল থেকে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সেই বছর থেকে ফেলের এমন রেকর্ড নেই। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চলা স্কুলটিতে সাত জন শিক্ষক রয়েছেন। এই বিদ্যালয়টিতে কখনও তিন, কখনও চার জন এসএসসিতে অংশ নিয়েছে। এমপিও না থাকায় বিদ্যালয়টির বড় সমস্যা শিক্ষক সংকট।

বিভিন্ন সময় বিদ্যালয়ের বিএসসি পাসসহ অন্য সহকারী শিক্ষকরা নিয়েছেন গণিত বিষয়ের ক্লাস। কথাটি অকপটে বললেও পরবর্তীতে অস্বীকার করেন প্রধান শিক্ষক নবীর উদ্দিন।

নবীর উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০০৭ সাল থেকে গণিত বিষয়ের শিক্ষক নেই। গণিত বিষয়ের ক্লাস নেন অন্য সহকারী শিক্ষক ও কৃষি শিক্ষক। এ বছর পাঁচ ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। সবাই গণিত বিষয়ে ফেল করেছে। কারণ গণিত বিষয়ের শিক্ষক নেই। গত বছর ছয় জন এসএসসি দিয়ে পাঁচ জন পাস করেছিল। এমন ভরাডুবি ফল হয়নি এর আগে। তবে খাতা পুনরায় দেখার জন্য আবেদন করবো।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোখলেসুর রহমান বলেন, স্কুলের অতীতে এমন রেকর্ড নেই। তাদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এমপিও রয়েছে। নবম-দশম শ্রেণির পাঠদান ও পরীক্ষার অনুমতি রয়েছে। গণিত বিষয়ের শিক্ষক অনেক দিন থেকেই নেই। আর দুই বছর আগে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মারা যাওয়ার পরে ওই পদ ফাঁকা আছে। তবে চাহিদা পাঠানো হয়েছে।

শতভাগ ফেলের কারণ হিসেবে মোখলেসুর রহমান আরও বলেন, এমন খারাপ ফলাফল কোন বছর হয়নি। শিক্ষক সংকট ছাড়াও ছাত্রীদের বাল্য বিবাহ একটা বড় সমস্যা। এবার পাঁচজনের মধ্যে দুই ছাত্রীই বিবাহিত ছিল। তারা পরীক্ষা দিয়েছে।

তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জেনেছি, তারা বলেছে, এতো খারাপ ফলাফল তাদের হওয়ার কথা না। তাদের মধ্যে অনেকেই ফলাফল চ্যালেঞ্জ করতে চান।

ঢোরসা আদর্শ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালামের মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তাই এ বিষয়ে তার কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক মহা. জিয়াউল হক কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। পুরো বিষয়টি বিদ্যালয় পরিদর্শক দেখেন। তবে বিষয়টি আমরা জানার চেষ্টা করবো। কেন এমন ফল হলো।

অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সীমান্তবর্তী গ্রাম ব্রজনাথপুর। ২০০০ সালে গ্রামটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় বজ্রনাথপুর দাখিল মাদ্রাসা। প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।

তবে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের দাখিল পরীক্ষায় মাদ্রাসাটির সব শিক্ষার্থী ফেল করেছে। শিক্ষকদের দাবি, প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকরা হতাশায় ভুগছেন, ছাত্রদের মানোন্নয়নে কাজ করতে পারছেন না। এ কারণেই গত দুই বছর টানা সব শিক্ষার্থী ফেল করেছে।

বজ্রনাথপুর দাখিল মাদ্রাসার সহ-সুপার আবু বাক্কার সিদ্দিক, সহকারী শিক্ষক ইজাজুল হক ও সহকারী শিক্ষিকা তানছিলা খাতুন জানান, মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠার পর নিয়োগ দেওয়া হয় সুপারসহ ১৫ জন শিক্ষক। স্থানীয়দের দানের টাকায় চলতে থাকে শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু শিক্ষকদের টাকায় জায়গা-জমি ও ভবন হলেও ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে শিক্ষার মান। যার প্রভাব পড়েছে ২০২৩ ও চলতি বছরের দাখিল পরীক্ষায়। দুই বছরই সবাই ফেল করেছেন।

সহকারী শিক্ষক ইজাজুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ২০০০ সালে মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হলেও তিনি নিয়োগ পান ২০০৪ সালে। এরপর থেকে ভবন নির্মাণসহ প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কাগজ নবায়ন বাবদ প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করেছেন। এরপর প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার আশায় কেটে গেছে ২০টি বছর। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান থেকে একটিও টাকা বেতন পাননি। বাড়ি থেকে টাকা এনে মাদ্রাসায় খরচ যোগাযোগ গিয়ে তিনি এখন নিঃস্ব। ইজাজুলের দাবি, বেতন-ভাতা না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। সে কারণে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।

মাদ্রাসাটির সহ-সুপার আবু বাক্কার সিদ্দিক জানান, ‘পড়ালেখা শেষ করে মাদ্রাসায় চাকরি নিয়েছিলাম। নিজের পরিবার থেকে টাকাপয়সা এনে মাদ্রাসার পেছনে খরচ করেছি। টাকা খরচ করতে গিয়ে পরিবারের কাছে অবহেলার পাত্র হয়েছি। যত দিন পেরিয়েছে, অভাবের কারণে তত মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়েছে। যার কারণেই শিক্ষার্থীদের মান উন্নয়নে কাজ করতে পারিনি। এ ছাড়া সুপারের গাফিলতির কারণে নিয়ম অনুযায়ী কাগজপত্র নবায়ন করা হয়নি।

সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারির সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আধুনিক যে-সব সামগ্রী থাকার কথা প্রতিষ্ঠানে, সেসবের তিল পরিমাণও নেই। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নেই। বারবার শিক্ষা অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনও সমাধান হয়নি। ফলে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের দাখিল পরীক্ষায় ফলাফলে সবাই ফেল। ২০২৩ সালে ১৪ জন ও এবার আট জন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়ে একজনও পাস করতে পারেনি।

পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষার্থী সিমলা খাতুন জানায়, দেড় বছর আগে মাদ্রাসায় পড়াকালেই তার বিয়ে হয়। স্বামীর সংসার সামলানোর পাশাপাশি পড়াশোনা করতে হয়েছে তাকে। এ ছাড়া পাঠদানের জন্য প্রতিষ্ঠানে আধুনিক ল্যাবসহ অবকাঠামো নেই। শিক্ষকেরাও পড়িয়েছেন গা ছাড়াভাবে।

মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আব্দুস সোবহান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দানের ওপর যুগ যুগ চলা যায় না, যার উদাহরণ বজ্রনাথপুর দাখিল মাদ্রাসা। যত দিন মানুষ নিজ ইচ্ছায় দান করেছে, ততদিন সঠিকভাবেই পরিচালিত হয়েছে। এখন মানুষ দান বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে আজ মাদ্রাসার ফল শূন্য।’

জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুর রশিদ বলেন, ‘মাদ্রাসাটি নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠান। সেখানে একটি মাদ্রাসা আছে বিষয়টি আমাদের নজরে ছিল না। ফল শূন্য হওয়ার পর আমরা জেনেছি। এ নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আহমেদ মাহবুব উল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরপর দুই বছর প্রতিষ্ঠানের ফল শূন্য হওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’