৫০ বছর ধরে কেন এত জনপ্রিয় ওহাবের কাঁচাগোল্লা?

৫০ বছরের বেশি সময় ধরে জনপ্রিয় ‘ওহাব ময়রার’ কাঁচাগোল্লা। সেইসঙ্গে তার তৈরি দইও বেশ জনপ্রিয়। বাবার হাতে তৈরি সেই কাঁচাগোল্লা ও দইয়ের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছেন তার ছেলে মহব্বত মোল্লা। নড়াইল সদরের কলোড়া ইউনিয়নের গোবরা বাজারের একসময়ের চায়ের দোকানটি এখন কাঁচাগোল্লার দোকান হিসেবে চেনেন সবাই। তবে ওহাব ময়রা বছর চারেক আগে মারা যান। বর্তমানে দোকানটি চালাচ্ছেন তার বড় ছেলে মহব্বত মোল্লা আর ছোট ছেলে হাসিব মোল্লা।

স্থানীয়রা বলছেন, বাজারের পূর্ব দিক দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। নদী ঘিরেই গড়ে উঠেছে গোবরা বাজার। বাজারটি ১০০ বছরের বেশি পুরোনো। আশপাশের চার ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষের প্রধান বাজার এটি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বাজারের ভেতরে ৫ শতাংশ জমির ওপরে মহব্বত মোল্লার চায়ের দোকান। দোকানের পেছনে রয়েছে কাঁচাগোল্লা ও দই তৈরির ঘর। প্রাচীন একটি হিজল গাছের নিচে বেশ খোলামেলা ঘরে রয়েছে বড় বড় দুটি চুলা। কাঠের খড়ির আগুনে বিশাল দুটি কড়াইয়ে জ্বাল দেওয়া হচ্ছে গরুর দুধ। একেক কড়াইতে ৩০-৫০ কেজি করে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ৩০ কেজি দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে কাঁচাগোল্লা তৈরির জন্য। অপর কড়াইয়ে ৫০ কেজি দুধ রয়েছে; যা থেকে তৈরি হবে দই। মহব্বত মোল্লার ছোট ভাই হাসিব মোল্লা আর তাদের দূর-সম্পর্কের আরেক ভাই কারিগর ইকবাল হোসেন কড়াইয়ের দুধ নেড়ে দিচ্ছেন।

হাসিব মোল্লা জানান, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় দুধ জাল দেওয়া আর বলক ওঠার সময় নাড়াচাড়া না করলে কাঁচাগোল্লা কিংবা দই কোনোটাই ভালো হয় না।

যেভাবে তৈরি হয় কাঁচাগোল্লা

ছানা তৈরির বর্ণনা দিয়ে হাসিব মোল্লা জানান, কাঁচাগোল্লার জন্য প্রথমে জ্বাল দেওয়া দুধ থেকে ছানা তৈরি করতে হয়। ছানা তৈরির জন্য আগের দিনের রাখা ছানার পানি নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্বাল দেওয়া দুধের সঙ্গে মেশাতে হয়। এরপর অল্প আঁচে রেখে দুধ নাড়তে হয়। একসময় ছানা কাটা হলে, তা একটি কাপড়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সেখানকার সব পানি শেষ না হয়। পানি ঝরানো শেষ হলে সেই ছানা ফের কড়াইতে নিয়ে অল্প আঁচে জ্বাল দিতে হয়। আর স্বাদের জন্য তাতে মেশাতে হয় পরিমাণ মতো চিনি।

বাবার হাতে তৈরি সেই কাঁচাগোল্লা ও দইয়ের ঐতিহ্য এখনও ধরে রেখেছেন তার ছেলে মহব্বত মোল্লা

হাসিব বলেন, ‘৩০ কেজি দুধ থেকে আমরা ছানা পাই পাঁচ-ছয় কেজি। এর সঙ্গে কেজিখানেক চিনি মেশাই। আরি ১০০ কেজি দুধ থেকে হয় ৫০ কেজি দই। প্রতিকেজি কাঁচাগোল্লা ৫০০ টাকা আর দই ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি।’

কাঁচাগোল্লা জনপ্রিয় হলো যেভাবে

ওহাব মোল্যার বাল্যবন্ধু বিনয় কুমার বিশ্বাসের ভাষ্যমতে, দেশ স্বাধীনের কয়েক বছর আগে গোবরা বাজারের এক কোণায় চায়ের দোকান দেন ওহাব মোল্যা ওরফে ওহাব ময়রা। চা দিয়ে শুরু হলেও কয়েক বছর পর কাঁচাগোল্লা ও দই বানানো শুরু করেন। তার তৈরি কাঁচাগোল্লার বিশেষত্ব হচ্ছে, তাতে দুধ-চিনি ছাড়া অন্য কিছু মেশানো হয় না। সে কারণে কাঁচাগোল্লা হয় ঝরঝরা। দই একদম জমাট বাঁধা আঠার মতো।

জনপ্রিয়তার মূল কারণ

বিনয় কুমার বলেন, ‘সে আমরা বাল্যবন্ধু। দেশ স্বাধীনের আগে ওহাব এই বাজারের এক কোণায় প্রথমে একটি চায়ের দোকান দেয়। সেই প্রথম আমাকে চা খাওয়ানো শিখিয়েছিল। কিছুদিন পর বানায় কাঁচাগোল্লা। পরে বানায় দই। অন্যরকম স্বাদের কারণে শুরু থেকেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার তৈরি কাঁচাগোল্লা ও দই। বাজারে তখনও দুই-চার জন ময়রা ছিল (মিষ্টান্ন প্রস্তুত করে যে সম্প্রদায় তাদের ময়রা বলে)। কিন্তু ওহাবের কাঁচাগোল্লা ও দইয়ের জনপ্রিয়তার কাছে টেকেনি কেউ। তার কাঁচাগোল্লা ও দই খাওয়ার পর মুখে লেগে থাকে। জনপ্রিয়তার মূল কারণ, তার কাঁচাগোল্লা ও দই একেবারে খাঁটি, একটুও ভেজাল নেই। সেসময় দুই-তিন শের কাঁচাগোল্লা ও দই বানাতো ওহাব। মজার ব্যাপার হলো, বানানোর পরপরই তা শেষ হয়ে যেতো। অন্য ময়রারা যে দামে বিক্রি করতো, ওহাব তাদের চেয়ে ২০ টাকা বেশিতে বিক্রি করতো। তবু তারই বেশি বেচাকেনা হতো।’

দোকানের পেছনে কাঁচাগোল্লা ও দই তৈরির ঘর

প্রতিদিন ১০০-১৩০ কেজি গরুর দুধ লাগে

মহব্বত মোল্লা বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দোকানে আসতাম। তখন দেখেছি, কীভাবে কাঁচাগোল্লা ও দই তৈরি করা হয়। ধীরে ধীরে তা শিখেছি। এই কাজের সঙ্গে আমার যোগসূত্র প্রায় ৪৩ বছরের।’

কাঁচাগোল্লা ও দই তৈরির জন্য স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করি জানিয়ে মহব্বত মোল্লা বলেন, ‘সপ্তাহের তিন দিন বৃহস্পতিবার, শুক্রবার আর শনিবার বেচাকেনা একটু বেশি হয়। প্রতিদিন ১০০-১৩০ কেজি গরুর দুধ লাগে। নড়াইল ও আশপাশের এলাকার লোকজন এখানে আসেন কাঁচাগোল্লা নিতে। এই গোল্লা দেশের বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যান লোকজন। এমনকি ভারত ও মালয়েশিয়ায় নিয়ে যান।’

বাজারের ভেতরে ৫ শতাংশ জমির ওপরে মহব্বত মোল্লার কাঁচাগোল্লার দোকান

ক্রেতারা বলছেন অতুলনীয়

বর্তমানে মহব্বত মোল্লার কাঁচাগোল্লা ও দইয়ের নিয়মিত গ্রাহক চিত্রা নদীর ওপারের বাসিন্দা নাজমুল হুসাইন। তিনি বলেন, ‘চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। নিয়েছি দই ও মিষ্টির স্বাদ। কিন্তু মহব্বত মোল্লার কাঁচাগোল্লা ও দইয়ের স্বাদ অন্য কোথাও পাইনি। এককথায় অতুলনীয়।’

গোবরা বাজারটি বহু পুরোনো, বাজারের র্পূব দিক দিয়ে বয়ে গেছে চিত্রা নদী। নদীর ধার বলেই মূলত এই বাজারটির গোড়াপত্তন বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা বয়োজ্যেষ্ঠ সহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কলোড়া, সিঙ্গাশোলপুর, বিছালি আর ভদ্রবিলা ইউনিয়নের লাখখানেক মানুষের বিচরণে জমে এই বাজার। এখানে ছয় শতাধিক দোকানপাট রয়েছে। এর মধ্যে ওহাবের কাঁচাগোল্লার দোকান সবার পরিচিত। সপ্তাহে শনিবার ও বুধবার দুই দিন হাট বসে।